গর্ভকালীন দশ মাসের স্বাভাবিক লক্ষণ সমূহ

ramoniyo symptoms during pregnancy

মনির এই প্রথম বাচ্চা হবে। সে বুঝে উঠতে পারছে না তার এতো বেশি দুর্বল কেনো লাগছে ! তলপেটে চিনচিন করে ব্যাথা করছে, আচ্ছা এটা কি নরমাল? সবারই কি এরকম হয় নাকি সুধু আমারই?

 সিন্থিয়া দ্বিতীয় বারের মতো মা হতে যাচ্ছে, আগেরবার প্রচণ্ড খুদা লাগতো , রুচিও ছিল বেশ, এবাড় কীছূ মুখেই দিতে পাড়ছে না,  সব বমি হয়ে যাচ্ছে। সব কিছুতেই গন্ধ লাগছে। এরকম কেনো হল?

নীলার তো বেশ মনে আছে , গতবার বেশ অনেক কাজ করেছিলো বাচ্চা পেটে নিয়েই, এবার কেনো পারছে না সে?

আসলে ব্যাপার কিছুই না, গর্ভকালীন সময়টা সপ্তাহে সপ্তাহে রুপ পাল্টায়। এই সপ্তাহে এই সমস্যা তো অই সপ্তাহেই অনেকটা ফ্রেশ লাগে। সাথে যোগ হয় নানান ধরনের হরমোনাল উপসর্গ, এই উপসর্গ গুলোও এতো বৈচিত্র পূর্ণ যে মনে দুশ্চিন্তা আসারই কথা, এটা কি সুধু আমার সাথেই হচ্ছে নাকি সবারই হয়?

তাই মনের খটকা দূর করতে জেনে নিন গর্ভকালীন নয় মাসের উপসর্গ গুলি।

প্রথম মাস (১ থেকে ৪ সপ্তাহ) 

  • স্তন বড় হবে এবং খুব কোমল অনুভূত হবে, সম্ভবত এটাই গর্ভ ধারনের প্রথম লক্ষন। স্তনে ব্যাথা অনুভুত হবে।
  • অবসাদ গ্রস্থতা । কোন কিছুই ভালো লাগেনা টাইপের অনুভূতি হতে পারে।
  • প্রচণ্ড খুদা বেড়ে যায়। মনে হয় একবার বসেই অনেক খাবার খেয়ে ফেলতে পারব। আবার দেখা যায় খাবার খাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই আবার খুদা লেগে যায়।
  • পরবর্তী পিরিয়ডের ডেট আসার আগেই এক দুই ফোটা বা তারও কম খুবই সামান্য বাদামি বা কালচে রক্ত মিউকাস দিয়ে যেতে পারে। এটা ইমপ্লান্টেশন ব্লিডিং। অনেক সময় খেয়াল না করলে এটা টের ও পাওয়া যায়না।
  • বমি বমি ভাব কিন্তু বমি না হওয়া, অথবা বমি বমি ভাবের সাথে বমিও হওয়া।
  • গ্যাসের সমস্যা বেড়ে যাওয়া ।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য ।
  • মাথা ধরা, মাথা ব্যাথা করা। 
  • মুড সুইং , এই ভালো লাগে তো এই মন খারাপ, আবার মেজাজটাও বিগড়ে যায় অকারনেই।
  • তলপেটে তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভূত হওয়া

দ্বিতীয় মাস (৫ থেকে ৮ সপ্তাহ)

  •  মর্নিং সিকনেস। এটা যে শুধু সকালেই হবে এমনটি কিন্তু নয়, দিনের যে কোন সময় এটা হতে পারে। এ সময় প্রচণ্ড মাথায় ব্যাথা , বমি বমি ভাব, অবসাদ গ্রস্থতা , দুর্বলতা সব মিলিয়ে খুব বিশ্রী একটা অবস্থা হয়। প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে মর্নিং সিকনেস হতে পারে, কারো কারো দিনের যে কোন সময়েই হতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মর্নিং সিকনেস সকালে ঘুম থেকে উঠার পরেই হয়ে থাকে। 
  • অতিরিক্ত আবেগ প্রবনতা বা যে কোন বিষয়ে প্রবল সেন্সিটিভিটি । মুড সুইং।
  • খিদের অভাব নেই কিন্তু খাবারে অনিহা, সাথে কিছু কিছু খাবারের গন্ধ, পারফিউম, মসলা বা অন্য যেকোন কিছুর গন্ধ সহ্য না হওয়া। তিব্র গন্ধের কারনে খেতে ইচ্ছে না করা, আবার রুচিও কমে যাওয়া।
  • বুক জ্বালা পোড়া করা, বদ হজম এবং গ্যাস আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য ।
  • ঢেঁকুর ।
  • অবসাদ গ্রস্থতা। 
  • তলপেটে চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হওয়া। 
  • অনেকের এই সময় হাল্কা ইমপ্লান্টেশন ব্লিডিং হতে পারে। হাল্কা লাল বা কালচে বাদামি বর্ণের রক্ত মিউকাসের সাথে মিশে বেড় হতে পারে। যেহেতু মিস্ক্যারেজ হওয়ার লক্ষণও ব্লিডিং হওয়া তাই দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওা উচিৎ।

তৃতীয় মাস (৯ থেকে ১২ সপ্তাহ)

  • ওজন বৃদ্ধি পাবে। 
  • অনেকে এই সময় আস্তে আস্তে শক্তি ফিরে পায়, কিন্তু তৃতীয় মাস পর্যন্ত মর্নিং সিকনেস থাকতে পারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই।
  • গ্যাস ভয়াবহ রকমের বেড়ে যায়, কাজেই গ্যাস এর তিব্রতা থেকে রক্ষা পেতে হলে বেশি বেশি পানি আর সবজি খাওয়া উচিৎ ।
  • ডিসচার্জ বৃদ্ধি পেতে পারে। 
  • শিরা উপশিরা চামড়ার নিচে স্পষ্ট হয়ে ফুলে উঠতে পারে। 
  • ঘন ঘন প্রস্রাব লাগে।
  • মাথা ঝিম ঝিম করে।
  • বমি বমি ভাব, বমির তিব্রতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
  • অবসাদ গ্রস্থতা।

চতুর্থ মাস (১৩ থেকে ১৬ সপ্তাহ)

  • মর্নিং সিকনেস, বমি বমি ভাবের প্রকটতা , মাথা ব্যাথা অনেকটা কমে যায়।
  • গন্ধ নিয়ে সমস্যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই সময় কেটে যায়, খাবারে রুচি বাড়ে। আচার জাতিয় টক, ঝাল খাবারের প্রতি আকরশন বেড়ে যায়। আগের তুলনায় খাবার বেশি খেতে পারে।
  • গর্ভস্থ শিশু মায়ের শরীর থেকে ক্যালসিয়াম গ্রহন করে তাই মায়ের ক্যালসিয়াম ঘাটতির কারনে দাঁত ও মাড়ি থেকে রক্ত পড়ে, ব্যাথা করে, ফুলেও যেতে পারে। অনেক সময় ব্যাথা ছাড়াই শুধু রক্ত পরতে পারে।
  • অনেকের এই সময় নাক দিয়ে রক্ত পরতে পারে।
  • প্রসাবের সময় ব্যাথা অনুভূত হতে পারে।
  • ভোঁতা অথবা তীক্ষ্ণ তলপেটের ডান দিকে বা বাম দিকে অথবা উভয় দিকে ব্যাথা করে। ইউটেরাস ক্রমশ বড় হওয়ার কারনে লিগামেন্ট পেশিতে টান পরে তাই এরকম ব্যাথা হয়।
  • অনেকে এই সময় বাচ্চার নড়াচড়া খুব হাল্কা ভাবে টের পান, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কেউ এই সময় টের পায়না। 
  • পেট বড় হতে শুরু করে।
  • পেটে মাতৃ জনিত দাগ পরা শুরু হতে পারে।

পঞ্চম মাস ( ১৭ থেকে ২০ সপ্তাহ)

  • এই সময়টা পুরো গর্ভকালীন সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আরামদায়ক। কারন এই সময় বমির সমস্যা একেবারেই কমে যায়, মাথা ঝিম ঝিম ভাব, অবসাদ গ্রস্থতা, দুর্বলতা কোনটাই  থাকেনা বরং কাজে শক্তি পাওয়া যায়। 
  • পেট চোখে পরার মতো বড় হয়ে যায়।
  • পেটের মধ্যে গ্যাসের গুটগুট অনুভূতি হতে পারে, আসলে এটা গ্যাস নয়, এটার আপনার গর্ভস্থ শিশু। এই সময় বাচ্চার নড়াচড়া বোঝা যায়। 
  • স্তন বড় হয়, স্তন বৃন্ত কালো আর বড় হয়। 
  • দম বন্ধ হওয়ার ভাব আসতে পারে। সাথে খুব অল্প সময়ের জন্য মাথা ঘুরে উঠতে পারে।
  • নাক, দাঁত ও মাড়ি থেকে রক্ত পরতে পারে। 

ষষ্ঠ মাস ( ২১ থেকে ২৪ সপ্তাহ)

  • গ্যাসের জন্য বুকে জ্বালা পোড়া করতে পারে।
  • ওজন বৃদ্ধির কারনে পায়ের গোড়ালি ব্যাথা হয় । অনেকের ক্ষেত্রে পা ফুলে যায়।
  • দীর্ঘ সময় পা ঝুলিয়ে বসে থাকা, দাড়িয়ে থাকা, হাঁটা খুবই কষ্টকর লাগে। 
  • পেট , পশ্চাৎদেশ, উরু চুলকাতে পারে।
  • পিঠ ও কমরের ব্যাথা প্রায় সবাই এই সমস্যায় ভুগে।
  • খুদা বৃদ্ধি পায়। অনেকে ঝালের প্রতি অনেকের মিষ্টির প্রতি আকরশন বৃদ্ধি পায়।
  • মাথা ঝিম ঝিম করে। 
  • বাচ্চা জোরে জোরে পেটে গুতো দিতে পারে। একে কুইকেনিং বলে। 
  • রাতে অনিদ্রার সমস্যা হয়। 

সপ্তম মাস ( ২৫ থেকে ২৮ সপ্তাহ)

  • পা, পিঠ, কোমর ব্যাথা করে।
  • হাত ও পা ফুলে যায়, ঝিঁঝিঁ ধরে এবং অস্বস্তিকর ব্যাথা করে।
  • পেট আরোও বড় হয়, ওজন বৃদ্ধি পায়। 
  • বাচ্চার নড়াচড়া তুলনা মুলক ভাবে কমে যায়।
  • শরীর চুলকায়।
  • বুকে গ্যাসের কারনে জ্বালা পোড়া করে।
  • মেরুদন্ড ব্যাথা করে।
  • দুর্বলতা বৃদ্ধি পায়।
  • স্ট্রেস মার্ক বৃদ্ধি পায়।
  • অবসাদ লাগে।

অষ্টম মাস ( ২৯ থেকে ৩২ সপ্তাহ)

  • দুশ্চিন্তা এবং  উদ্বেগ বৃদ্ধি পায়।
  • পাইলস হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
  • ব্রেক্সটন হিক্স অর্থাৎ ফলস পেইন হতে পারে মাত্র ৩০ সেকেন্ড থেকে দেড় মিনিটের জন্য।
  • বুক জ্বালা পোড়া করে।
  • পা ব্যাথা।
  • মাথা ব্যাথা করা।
  • ঘন ঘন প্রস্রাব পায়।
  • ক্লান্ত লাগে।  

নবম মাস ( ৩৩ থেকে ৩৬ সপ্তাহ)

  • যখন তখন ব্রেক্সটন হিক্স হয় ।
  • চোখে ঝাপসা দেখা।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য বেড়ে যায় ফলে পাইলসের সমস্যা হতে পারে।
  • গ্যাসের জন্য বুক জ্বালা পোড়া করে।
  • তলপেটে চাপ অনুভূত হয়।
  • ক্লান্তি ও অবসাদ গ্রস্থতা বৃদ্ধি পায়।
  • আসন্ন ডেলিভারির দুশ্চিন্তায় বা সারা শরীরে ব্যাথার কারনে রাতের ঘুমে বিঘ্ন ঘটে।
  • পিছনে কোমরের নিচের দিকে ব্যাথা বেড়ে যায়।
  • দম বন্ধ লাগে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
  • পা ও গোড়ালি অনেক ফুলে যায় ও ব্যাথা হয়।
  • ডিসচার্জের প্রকৃতিতে পরিবর্তন দেখা যায়। 

দশম মাস (৩৭ থেকে ৪০ সপ্তাহ)

  • গর্ভস্থ শিশুর মাথা তলপেটে স্থির হয়, যথেষ্ট জায়গার অভাবে আর পজিশন পরিবর্তন করতে পারেনা। তাই বাচ্চার নরাচরা কমে যায়।
  • স্তনে পরিবর্তন ব্যপক ভাবে দেখা যায়। বড় হয়, স্তন বৃন্ত বড় ও কালো হয় এবং বাচ্চাকে দুধ খাওানোর জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত থাকে।
  • তলপেটে ব্যাথা হয়।
  • মিউকাসের সাথে মিশে গারো বাদামি বর্ণের হাল্কা রক্তপাত হতে পারে, এটা প্রসবকালীন একটা পূর্ব লক্ষণও বটে। 
  • পা ব্যাথা।
  • ডিসচার্জ নির্গতের পরিমান বৃদ্ধি পায়। যদি একদম পানির মতো পাতলা ডিসচার্জ প্রচুর পরিমানে বেড় হয় সাথে সাথে নিকটস্থ ডাক্তারের কাছে যান কারন পানিও ভেঙ্গে যেতে পারে।

এখানে খুব সংক্ষেপে গর্ভকালীন দশ মাসের লক্ষন গুলো বর্ণনা করা হয়েছে এবং প্রতি ৪ সপ্তাহে ১ মাস গননা করা হয়েছে। এটা মনে রাখতে হবে ৮০% মেয়েদের ক্ষেত্রেই এইসব লক্ষন প্রকাশ পেলেও অনেকেরই এর ব্যাতিক্রম হতে পারে, মেডিকেল টেস্ট রিপোর্ট অনুযায়ী যদি ভ্রূণ সুস্থ থাকে তাহলে কেনো এইসব লক্ষন আপনি টের পাচ্চেন না এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এইসব লক্ষন হরমোন পরিবর্তনের ফল মাত্র। এক একজনের ক্ষেত্রে এক এক রকম হতে পারে। কিন্তু সাধারনত এইসব লক্ষন দেখা দিলে উদ্বিগ্ন না হয়ে বুঝতে হবে আপনি একা নন আরও অনেকেই এইসব লক্ষনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। সর্বোপরি যেকোন বাড়াবাড়ি রকমের অসুবিধা এবং কষ্টের জন্য সব সময় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ি চলতে হবে। পরের ব্লগে গর্ভকালীন ১০ মাসে ভ্রূণের ক্রম পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সম্পর্কে আলোচনা করা হতে। আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।


Leave a Reply

Your email address will not be published.