গর্ভধারণ-পূর্ব সমস্যা আর তার সমাধান

ramoniyo how to get pregnant?

সায়েম আর মিলার দাম্পত্য জীবনটা বেশ সুখেই কাটছে। সংসারের কোথাও কোন ঘাটতি নেই। দুজনের আয়ে বেশ চলে যায় তাদের ছোট্ট সংসার। কিন্তু বিয়ের বছর ঘুরতেই তারা বুঝতে পারলো তাদের সংসারেও একটা বেশ বড় রকমের সমস্যার আগমনের পূর্বাভাষ পাচ্ছে। মিলার পিরিয়ড নিয়মিত

ছিল,সায়েমেরও আপাত দৃষ্টিতে কোন শারিরিক সমস্যা নেই, কিন্তু ৬/৭ মাস চেষ্টা করেও মিলা কন্সিভ করছে না। প্রতি মাসে রুটিন মাফিক তারা চেষ্টা করেই যাচ্ছে।তারা সিদ্ধান্ত নিলো ডাক্তারের পরামর্শ নেয়ার। চেক আপ করে দেখা গেলো দুজনের মাঝে কারই কোন সমস্যা নেই। ডাক্তার কিছু ভিটামিন লিখে দিয়ে বলল, কীপ ট্রায়িং।কিন্তু আরও কিছু মাস চলে গেলো, দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেলেও মিলা কন্সিভ করছিলো না, আর এটা নিয়ে মিলার দুশ্চিন্তার ও শেষ ছিল না, রাতের ঘুম,খাওয়া দাওয়া  কোনটাই আর নিয়মিত হচ্ছিলো না তার।

 

অন্য দিকে আরিফ আর সাবিনার সমস্যাতাও একি রকম হলেও সেখানে আর একটি সমস্যা ছিলো, সাবিনার পিরিয়ড নিয়মিত ছিলো না। সাবিনা নিজেও বুঝতে পারতো না তার পিরিয়ড  কবে হবে।এছাড়া আর কোন সমস্যা দুজনের মাঝে ছিলও না। তারাও প্রতি মাসে চেষ্টা করতো কিন্তু শুভ সংবাদটা আর ধরা দিতো না। ফলাফল দিনদিন সাবিনা দুশ্চিন্তার চাদরে নিজেকে আবৃত করে ফেলল,সাথে ঘুমের সমস্যা, খাওয়া দাওয়ার অনিহা তো আছেই।

 

নাহিদ আর তরুর সমস্যাটা ছিল বেশ জটিল। তরুর ওভারিতে PCOS (poly cystic overy syndrom) ধরা পরে। দুজনেরই মনে ধারনা জন্ম নেয়, বাচ্চা নেয়ার আশা হয়ত তাদের ছাড়তে হবে।তরু আর নাহিদ উভয়েই ভেঙ্গে পরে।

 

এসব দম্পতির চেয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যায় ছিল আসিফ আর তানিয়া। কারন ১/২ বছর চেষ্টা করেও যখন তানিয়া কন্সিভ করছিলো না তখন তারা দুজনেই ডাক্তারের পরামর্শে পরিক্ষা করতে আসিফের azoospermia ধরা পরে। কাজেই দুজনেই হতাশ, আর সংসারে ভালবাসার কমতি না থাকলেও হতাশা ধিরে ধিরে সম্পর্কটাকে গ্রাস করতে থাকে।

 

উপরের ঘটনা গুলোর চরিত্র কাল্পনিক হতে পারে কিন্তু সমস্যা গুলো মোটেও কাল্পনিক নয়।বাংলাদেশের শহুরে দম্পতিরা এসব সমস্যায় হর হামেশাই ভুগতে দেখা যায়।কিন্তু  প্রযুক্তির কল্যানে এখন এসব সমস্যা সমাধানের উপায়ও বেড় হয়ে গেছে অনেক আগেই। তারপরেও যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হল দৃঢ় মনবল আর সুস্বাস্থ্য।জেসব দম্পতি সায়েম আর মিলার মত কোন সমস্যা না থেকেও কেনো কন্সিভ হচ্ছে না চিন্তায় নিজের মন শরীর দুটোই নষ্ট করছেন তারা একটু সতর্ক হলেই কন্সিভ করতে পারেন।একজন নারীর প্রতি মাসে একটি করে ডিম্বাণু তৈরি হয়। সাধারনত ২৮ থেকে ৩৫ দিন পর পর প্রতি মাসে পিরিয়ড হয়ে থাকে। আপনার পিরিয়ড যদি ২৮ দিন পরপর হয়ে থাকে তাহলে আপনার সম্ভাব্য অভ্যুলেশন ( ডিম্বাণু তৈরি সম্পন্ন) হবে শেষ পিরিয়ডের ১ম দিন থেকে গননা করে ১৪তম দিনে। প্রতি মাসে একই দিনে অভ্যুলেশন হয়না, দিন আগু পিছুও হতে পারে।একটি ডিম্বাণু ফেলপিয়ান টিউবে ১২ থেকে  ২৪ ঘন্টার মত অবস্থান করে, এসময় শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত না হলে ডিম্বাণুটি নষ্ট হয়ে যায়। কাজেই, কন্সিভ করার সবচেয়ে বেশি আদর্শ সময় হচ্ছে পিরিয়ডের ৮ম দিন থেকে ২০তম দিন পর্যন্ত। সহবাসের পর শুক্রাণু ফেলপিয়ান টিউবে ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছতে সময় লাগে ৪৮ ঘন্টা, তাই অভ্যুলেশনের কমপক্ষে দুদিন আগেই বা আগের দিন সহবাস বেশি ফল্প্রসু হয়ে থাকে। এজন্যই ৮ম দিন থেকে ২০তম দিন পর্যন্ত কন্সিভ করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে পিরিয়ডের ১ দিন আগে সহবাস করেও মানুষ গর্ভ ধারন করতে পারে। এখন বাজারে অভ্যুলেশন কিট কিনতে পাওয়া যায় যার মাধ্যমে আপনি আপনার অভ্যুলেশন ট্র্যাক করতে পারবেন খুব সহজেই। অনেক ক্ষেত্রে নিয়মিত পিরিয়ড আর অভ্যুলেশন হলেও TVS পদ্ধতিতে  ডিম্বাণুর আকার নির্ণয় করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে , গর্ভ ধারনের জন্য ডিম্বাণুর সাইজ ১৮ থেকে ৩৬ মিমি পর্যন্ত হয়ে থাকে।অনেক সময় ডিম্বাণু তার অভীষ্ট আকারে পৌঁছতে পারেনা তাই সঠিক সময়ে সহবাস করার পরেও কন্সিভ হয়না। এক্ষেত্রে ডাক্তার মেডিসিন অথবা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ডিম্বাণুর আকৃতি বড় করে থাকেন। প্রাকৃতিক উপায়ে ডিম্বাণুর সাইজ বড় করার উপায় হল প্রচুর পানি পান করা,ব্যায়াম বা হাটাহাটি করা, পর্যাপ্ত পরিমানে ঘুম এবং ভিটামিন বি ১২ গ্রহন করা।আশা করা যায় এই বিষয় গুলো মাথায় রেখে কন্সিভ করার চেষ্টা করলে একটা ভালো ফলাফল অবশ্যই পাওয়া যাবে। অভ্যুলেশনের লক্ষন, অভ্যুলেশনের কিট ব্যবহার পদ্ধতি এবং গর্ভ ধারনের জন্য উপযুক্ত সহবাস পদ্ধতি সম্পরকে আমার পরবর্তী ব্লগে আলচনা করা হবে।

 

অনিয়মিত পিরিয়ডের ক্ষেত্রে দম্পতিরা প্রায়শই হতাশায় ভুগে থাকে কারন এক্ষেত্রে তারা অভ্যুলেশনের সময়টাকে কোন ছকে ফেলতে পারেনা। এমনকি অভ্যুলেশন কিট কখন ব্যবহার করবে সেটা ও একটা প্রশ্ন। এক্ষেত্রে সর্ব প্রথম ডাক্তারের মাধ্যমে পরিক্ষা করে দেখতে হবে যে ডিম্বাশয়ে কোন সিস্ট আছে কিনা।সাধারনত হরমন বা PCOS( poly cystic overy syndrom) এর কারনে অনিয়মিত পিরিয়ড হয়ে থাকে।  যদি সিস্ট না থেকে থাকে তাহলে জেনে রাখুন, অনিয়মিত পিরিয়ডের খেত্রেও অভ্যুলেশন সংঘটিত হয় কিন্তু সেটা নির্দিষ্ট সাইকেল পর পর হয়না, কিন্তু এখনও আপনার গর্ভ ধারনের বিশাল নিশ্চয়তা রয়েছে। অভ্যুলেশন ট্র্যাক করার জন্য নিজের পিরিয়ডের ডেট গুলোর একটা চার্ট করুন, যদিও তারিখ গুলো খুবি এলোমেলো কিন্তু হয়ত আপনি একটা সামঞ্জস্যতা খুঁজে পেলেও পেতে পারেন, যেমন ২ মাস পরপর পিরিয়ড বা ৬২ থেকে ৭০ দিন পর পর পিরিয়ড হলে সেটাই আপনার জন্য পিরিয়ড সাইকেল। সারভিক্যাল মিউকাস এর দিকে খেয়াল রাখুন।অভ্যুলেশনের সময় মিউকাসের বর্ণ এবং প্রকৃতি চেঞ্জ হয়।এসময় মিউকাস বেশি আঠালো এবং অধিক পরিমানে নির্গত হয়।নিজের শরীরের তাপমাত্রার উপরে লক্ষ্য রাখুন, অভ্যুলেশনের সময় শরীরের তাপমাত্রা উঠানামা করে। এমন অবস্থায় সহবাস করলে একটা ভালো ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনা ৯০% বেড়ে যায়। সর্বোপরি বেশি বেশি পানি পান করুন,দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকুন আর স্বাস্থ্যকর  খাবার গ্রহন করুন এবং অবশ্যই খাবারের তালিকায় ফলিক এসিড যুক্ত করতে ভুলবেন না কারন ফলিক এসিড ডিম্বাণু কে পরিপুষ্ট ও পরিপূর্ণ হতে সাহায্য করে।

 

PCOS( poly cystic overy syndrom) একটি রোগ যাতে প্রতি ১০জন মেয়ের মধ্যে ১জন এই সমস্যায় ভুগে। এটি মেয়েদের গর্ভ ধারন করার বয়সে উপনিত হবার পরেই হয়ে থাকে।অতিরিক্ত পুরুষ হরমনের প্রভাবে এই জটিলতার সৃষ্টি হয় যার ফলে অনয়মিত পিরিয়ড বা দীর্ঘস্থায়ী পিরিয়ডের সমস্যা দেখা দেয়। গর্ভাশয়ে ছোট ছোট অনেক গুলো কোষ সিস্ট এর জন্ম দেয় যেগুলো ক্ষতিকর না হলেও ডিম্বাণু তৈরিতে বাঁধা দেয়। PCOS হরমন ও বিপাকের ভারসাম্য নষ্ট করে ফলে স্বাস্থ্য ও উর্বরতার উপরে ব্যপক প্রভাব বিস্তার করে। PCOS হলেই যে সব শেষ আর বাচ্চা হবেনা এমন ধারনা সম্পুরন ভিত্তিহীন, এখন

PCOS এর অনেক উন্নত চিকিৎসা আছে, নিয়মিত চিকিতস্যা নিলে কয়েক মাসে মধ্যেই এই সমস্যা নিরসন সম্ভব এবং গর্ভ ধারণও সম্ভব। এমনকি অনেক অনেক নারী আছেন যারা PCOS এর উপস্থিতির মাঝেও গর্ভ ধারণ করেছেন। তবে আমার পরামর্শ হবে আগে ট্রিটমেন্ট নিন তারপর কন্সিভের জন্য চেষ্টা করুন।

 

পুরুষ সঙ্গীর azoospermia হলেও হতাশ হবেন না।আজকাল এর চিকিতস্যাও আছে আমাদের দেশেই। azoospermia হল পুরুষদের সিমেনে শুক্রানুর অনুপস্থিতি। এটি পুরুষ প্রজনন তন্ত্রের ব্লকেজ এর কারনে বা দুর্বল শুক্রানু উৎপাদন এর কারনে হয়ে থাকে, সাধারণত দুর্বল শুক্রানু গুলো একেবারেই অনুরবর হয়ে থাকে।তাই সন্তান উৎপাদনে তারা অক্ষম হয়। যদি পুরুষ প্রজনন তন্ত্রের ব্লকেজ এর কারনে শুক্রানুর উপস্থিতি নীল হয় তাহলে অপারেশনের মাধ্যমেই ব্লকেজ দূর করে বন্ধ্যত্ব দূর করা সম্ভব।স্বল্প পরিমানে শুক্রানুর সমস্যা যাদের তারা কোন অসুধ ছারাই শুক্রানু উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারেন কিছু সহজ নিয়ম মানার মাধ্যমে।নিয়মিত ঘুম, পুষ্টিকর খাবার গ্রহন এবং ধুম্পান না করা , এই তিনটি জিনিস এর ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলেই শুক্রানুর পরিমান এবং উরবরতা বৃদ্ধি পায়। যাদের একেবারেই শুক্রানু নেই তাদের ক্ষেত্রে স্পারম রিট্রাইভাল টেকনিক এর মাধ্যমে সরাসরি টেস্টিকল থেকে শুক্রানু উৎপাদন করা সম্ভব, কিন্তু সব সময় এটা বন্ধাত্ব্য কে দূর করে না।

 

বন্ধ্যা পুরুষ বা বন্ধ্যা নারী যাদের গর্ভাশয়ের মধ্যে ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়না তাদের জন্য IVF পদ্ধতিতেও সন্তান উৎপাদন করা সম্ভব।  IVF পদ্ধতি, বাংলাদেশে এই চিকিতস্যা ব্যবস্থা, খরচ সম্পর্কে পরবর্তী ব্লগে বিশদ আলোচনা করা হবে।

 

পরিশেষে সবার ক্ষেত্রেই একটা কথা মেনে চলা খুবি জরুরী, আর তা হল দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকুন,প্রচুর পানি পান করুন এবং পর্যাপ্ত পরিমানে ঘুমান। সম্পূর্ণ পজিটিভ চিন্তা নিয়ে সন্তান নেয়ার চেষ্টা করুন আর সৃষ্টিকর্তার উপরেবিশ্বাস রাখুন। সমস্যা অনুযায়ী ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং ধৈর্য ধরে চিকিতস্যা সম্পন্ন করুন। সকলের জন্য  শুভ কামনা রইলো।


Leave a Reply

Your email address will not be published.