জেনে নিন এখন আপনার শিশুটি গর্ভে যে অবস্থায় আছে

prenatal-development

মা তার সন্তানকে পরম মমতায় দশ মাস গর্ভে ধারন করেন । প্রতি মাসে মাকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সন্মুখিন হতে হয় একজন মা’কে। গর্ভের সন্তাঙ্কে টিকিয়ে রাখতে মায়ের সাথে সাথে শিশুর পিতা এবং পরিবারের সকলেই উদ্বিগ্ন থাকেন যেনো মায়ের কোন অসুবিধা নাহয়, মায়ের যত্নের অবহেলা না হয়। আলোচনা চলে এসময় কি কি খেতে হয় আর কোন কোন খাবারটি খেতে নেই, কোন কাজটি একেবারেই করতে নেই, এতে শিশুর ক্ষতি হতে পারে। যাকে নিয়ে এতো আয়োজন ,এতো ব্যস্ততা কিভাবে বেড়ে উঠছে মায়ের সেই শিশুটি? আমাদের সবারই তা জানতে ইচ্ছে করে। অনেকে মনে করেন প্রথম ৩ মাসে হয়ত বাচ্চার হাত পা, চোখ নাক মুখ কিছুই থাকেনা, অনেকে মনে করেন পেটের ভিতরে শিশুটি নড়াচড়া করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার শরিরে জীবন থাকেনা। আসলেই কি তাই? আর নয় কল্পনা আর ভুল ধারনা, আসুন জেনে নেয়া যাক গর্ভস্থ ভ্রূণ কোন মাসে মায়ের গর্ভে কি অবস্থায় থাকে। 

প্রথম মাস (১ থেকে ৪ সপ্তাহ)

  • শুক্রানু ও ডিম্বাণুর মিলনের ফলে জাইগোট তৈরি হয়। মনে রাখতে হবে আপনার শিশুর জীবন এখান থেকেই শুরু হয়। এটি আর কোন জড় পদার্থ নয় কারন ধিরে ধিরে এটি পরিবর্তিত হয়ে মানুষের আকার ধারন করবে। ইতিমধ্যেই এটি আপনার শরীর থেকে প্রয়োজনিয় উপাদান গ্রহন করে নিজেকে পরিপুষ্ট করতে শুরু করেছে। ডিম্বাণু ও শুক্রানু মিলিত হবার সাথে সাথেই এটা জেনেটিক ভাবে নির্ধারণ  হয়ে যায় যে শিশু মেয়ে হবে নাকি ছেলে। জাইগোট টি বিভাজিত হতে থাকে খুব দ্রুত, ১টি কোষ থেকে ২টি,২টি কোষ থেকে ৪টি , ৪টি কোষ থেকে ৮টি এভাবে আস্তে আস্তে একটা বলের মতো আকারে আসতে থাকে আর ফেলোপিয়ান টিউব থেকে ইউটেরাসের দিকে ছুটতে থাকে।
  • বলের মতো আকৃতিটির ( আপনার ভবিষ্যৎ শিশু) বাহিরের স্তরটি প্লাসেন্টা আর ভিতরের স্তরটি শিশুর শরীর গঠনে অংশ নেয়।
  • ৪র্থ সপ্তাহে ভ্রূণ ইউটেরাসে সংযুক্ত হয় একে ইমপ্লান্টেশন বলে।

দ্বিতীয় মাস ( ৫ থেকে ৮ সপ্তাহ)

  • ভেতরের স্তরটি হৃদপিণ্ড, মস্তিস্ক, স্পাইনাল কর্ড ( মেরুদণ্ড), পেশি , হাড় , অন্ত্র, ফুস্ফুস। এপেন্ডিক্স, নাসারন্ধ্র , মুখ গহবর, চোখ তৈরী করতে শুরু করে এবং ৮ সপ্তাহের শেষের দিকে আরও সুগঠিত হয়।
  • বাহিরের যে স্তরটি প্লাসেন্টা তৈরি করে সেটাও খুব দ্রুত একটা উষ্ণ, আরামদায়ক, তরলে পূর্ণ একটি গহবরে পরিনত হয় যা ভ্রূণ কে নড়াচড়া ও ধারন করার কাজে নিয়োজিত।
  • নাড়ী তৈরি হয়ে যায় এই মাসেই যা মায়ের সাথে শিশুর সংযোগ স্থাপন করে। মায়ের শরীর থেকে পুষ্টি , অক্সিজেন এই নাড়ের মাধ্যমে ভ্রূণের শরীরে প্রবেশ করে, আর ভ্রূণের শরীরে তৈরি বর্জ্য পদার্থ এই নাড়ের মাধ্যমেই মায়ের শরীরের মাধ্যমে বাইরে নির্গত হয়।
  • ৬ষ্ট সপ্তাহের মধ্যে হাত, পা আর শরীরের অবয়ব স্পষ্ট হতে শুরু করে।
  • ৭ম সপ্তাহে আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে হার্ট বিট শোনা যায়।
  • ৮ম সপ্তাহের শেষের দিকে চোখের পাতা, আঙ্গুল, পায়ের পাতা স্পষ্ট হয় এবং মাতৃ গর্ভে সাঁতার কেটে ঘুরে বেরাতে পারে।

তৃতীয় মাস ( ৯ থেকে ১২ সপ্তাহ)

  • ভ্রূণের পেশিগুলো আরও মজবুত হতে শুরু করে।
  • কুনুই, হাটু, গোড়ালির জয়েন্ট গুলো তৈরি হয়ে যায়।
  • ৯ম সপ্তাহের যে কোন সময়ে পায়ের আঙ্গুল গুলোর নখ তৈরি হতে শুরু করে। 
  • ১০ সপ্তাহের মধ্যে ভ্রূণ দুই হাত নাড়াতে পারে।
  • চোখের পাতা গুলো আরো স্পষ্ট হয়।
  • জিহ্বায় স্বাদের কোষ গুলো তৈরি হতে শুরু করে।
  • মাথার দুই পাশে কান তৈরি হয়ে যায় এবং কানের ভিতরের গঠন আসতে আসতে উন্নত হতে থাকে।
  • মাড়ির নিচে দাঁত তৈরী হতে থাকে যা জন্মের পর ১ বছরের জন্য সুপ্ত থাকে। কিন্তু মাড়ির উপর দিয়ে দাঁতের অবয়ব স্পষ্ট হয়।
  • নখ বড় হতে থাকে।
  • মুখের ভিতরের তালু সুগঠিত হয়।
  • ১২ সপ্তাহের মধ্যে ভ্রূণ ২.৫ ইঞ্চির মতো লম্বা হয়।

চতুর্থ মাস ( ১৩ থেকে ১৬ সপ্তাহ)

  • ১৩ সপ্তাহের মধ্যেই ভ্রূণ ৩ ইঞ্চি লম্বা হয়ে যায়।
  • হাত পা নিয়মত নারাচারা করতে থাকে।
  • মেয়ে শিশু হলে স্ত্রী বহিঃপ্রজনন তন্ত্র  এবং ছেলে হলে পুরুষ বহিঃপ্রজনন তন্ত্র তৈরি হয়ে যায়। যদিও তা আলট্রা সাউন্ডের মাধ্যমে তা সনাক্ত করা যায় না কারন আকারে খুব ছোট থাকে।
  • ফিঙ্গার প্রিন্ট স্পষ্ট হয়।
  • ১৪ সপ্তাহের মধ্যে ৩.৩৪ ইঞ্চি লম্বা হয়ে যায়।
  • এ সময়ে ভ্রূণ এমনোইটিক ফ্লুয়িড খায় যা তার রেচন তন্ত্রে প্রবেস করে, রেচন তন্ত্র এই সময় কাজ করতে শুরু করে এবং তা পুনরায় শরীরের বাইরে প্রসাবের মাধ্যমে বেড় করে দেয়।
  • ১৫ সপ্তাহের মধ্যেই ভ্রূণ মায়ের পাচন তন্ত্রের, হৃদপিণ্ডের এবং কন্ঠ স্বর শুনতে পায়।
  • চোখ বন্ধ থাকলেও উজ্জ্বল আলোর উপস্থিতি তারা টের পায় যা মায়ের পেটের চামড়া ভেদ করে শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে।
  • ১৬ সপ্তাহের মধ্যে ভ্রূণের মুখের মাংস পেশি সুগঠিত হয় এবং যে কোন অভিব্যাক্তি তার চেহারায় প্রকাশ পেতে শুরু করে ।
  • দুই হাত দিয়ে কিছু ধরার চেষ্টা করে এবং মাঝে মাঝে নাড়ি ধরে ফেলে। 
  • দুই হাত পরস্পরকে স্পর্শ করতে পারে।

৫ম মাস ( ১৭ থেকে ২০ সপ্তাহ)

  • ১৭ সপ্তাহে ভ্রূণ খুব দ্রুত বেড়ে উঠতে থাকে। ওজন হয় প্রায় ১৫০ গ্রামের মতো।
  • চোখের মনি নাড়াতে পারে যদিও চোখের পাতা বন্ধই থাকে।
  • ভ্রূ ও চোখের পাপড়ি তৈরি হয়।
  • মুখ বন্ধ করতে ও খুলতে পারে।
  • হাতের রেখ আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়।
  • এই সময় ভ্রূণ বাহিরের আওয়াজে সাড়া দেয়। 
  • ভ্রূণের নড়াচড়া বেড়ে যায়, যদিও সব মায়েরা এতো তারাতারি বাচ্চার নড়াচড়া টের পায়না।
  • ২০ সপ্তাহের মধ্যে সারা সাদা আঠালো পদার্থ দ্বারা সারা শরীর ঢেকে যায় একে ভারমিক্স বলে যা, এমনোইটিক ফ্লুয়িড থেকে শিশুকে শুস্কতা হতে রক্ষা করে। 
  • আলট্রা সাউন্ডের মাধ্যমে লিংগ নির্ণয় সম্ভব হয়।

৬ষ্ঠ মাস ( ২১ থেকে ২৪ সপ্তাহ)

  • ভ্রূণ এই সময় দ্রুত নড়াচড়া করে এবং আকারে বড় হওয়ার কারনে মা তার বাচ্চার নড়াচড়া টের পেতে শুরু করে।
  • ফুস্ফুস ধিরে ধিরে সুগঠিত হতে থাকে।
  • চামড়া অসংখ্য ভাজযুক্ত হয় কারন ভ্রূণের বিকাশ শেষ হয়নি বরং প্রতি নিয়ত তা বারছে।
  • নিজেকে গরম রাখতে শরীরে চর্বি উৎপাদন করে।
  • ভ্রূণ নিজের শরীরে স্বেত রক্ত কনিকা তৈরি করে এবং জিবানু প্রতিরোধ করে।
  • মায়ের আওয়াজ চিনতে পারে এবং মায়ের কণ্ঠ স্বরে সাড়া দিয়ে নড়াচড়া করে।

৭ম মাস ( ২৫ থেকে ২৮ সপ্তাহ)

  • হাড় মজবুত হতে থাকে, এই সময় ভ্রূণ অনেক বেশি ক্যালসিয়াম মায়ের শরীর থেকে নেয় ।
  • নিঃশ্বাস নেয়ার মতো বুক উঠানাম করে কিন্তু নিঃশ্বাস নিতে পারে না কারন সেখানে কোন বাতাস নেই, নাড়ের মাধ্যমে মায়ের শরীর থেকে অক্সিজেন জন্মের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সরবরাহ হতে থাকে এবং কেবল মাত্র জন্মের পরেই ভ্রূণ নিঃশ্বাস নিতে সক্ষম হয়।
  • ২৮ সপ্তাহের শেষের দিকে ভ্রূণ ১৪.৫ ইঞ্চি লম্বা এবং ২-২.৫ পাউন্ড অজনের হয়।
  • চোখ বন্ধ ও খুলতে পারে।
  • আলো ও অন্ধকার বুঝতে পারে কিন্তু স্পষ্ট কিছুই দেখতে পারে না।
  • মা বসে থাকলে বা খাবার খাওয়ার পর বাচ্চার নড়াচড়া বেশি টের পায়।
  • মাথা এদিকে সেদিকে ঘুরাতে থাকে।
  • মস্তিস্কের বিকাশ ঘটতে থাকে।
  • বোনম্যারো তে লোহিত রক্ত কনিকা উৎপন্ন হয়।

৮ম মাস ( ২৯ থেকে ৩২ সপ্তাহ)

  • এই সময়ের মধ্যে ভ্রূণ আঙ্গুল চুষতে শিখে যায়।
  • ভ্রূণের শরীরের ভাঁজ কমতে থাকে এবং ওজন বাড়ার সাথে সাথে চামড়া মসৃণ হতে থাকে।
  • ফুস্ফুস পরিপূর্ণ হতে থাকে এবং ভ্রূণ মাতৃ গর্ভেই শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করে। 
  • কেন্দ্রীয় স্নায়ু তন্ত্র পরিপূর্ণতা লাভ করে, এটি শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করে।

৯ম মাস ( ৩৩ থেকে ৩৬ সপ্তাহ)

  • ফুস্ফুস, মস্তিস্ক, পরিপাক তন্ত্র পরিপূর্ণতা লাভ করে ।
  • ভ্রূণের হাড় মজবুত হয়, শুধু ঘারের হাড় নরম থাকে যেনো প্রসব কালীন সময়ে সহজে ভুমিষ্ঠ হতে পারে। ঘারের হাড় শক্ত হয় জন্মের পর। 
  • ভ্রূণের জায়গা কম হওয়ার কারনে হাত পা গুটিয়ে থাকে এবং সুবুধা মতো নড়াচড়া করতে পারেনা।
  • ছেলে শিশু হলে টেস্টিকল তলপেট থেকে অণ্ডকোষে নেমে আসে।

১০ মাস ( ৩৭ থেকে ৪০ সপ্তাহ)

  • এই সময় ভ্রূণ গঠন গত দিক থেকে পরিপূর্ণ হয় এবং যেকোন সময় ভুমিষ্ঠ হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে।
  • ভ্রূণের অন্ত্রে সবুজ, আঠালো বস্তু দ্বারা পূর্ণ থাকে, জন্মের পরে এটিই সর্ব প্রথম প্রথম মল হিসেবে বেড় হয়।
  • শরীরের আবৃত লোমগুলো বিলুপ্ত হয়।

সাধারনত ৩৬ সপ্তাহ থেকেই গর্ভবতী মা কে যেকোন সময় প্রসবের জন্য মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হয়। কারন শিশু এই সময়ের মধ্যেই পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং ফুস্ফুস বাহিরের পৃথিবীতে শ্বাস নেয়ার উপযোগি হয়ে থাকে। শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের জন্য মা কে অবশ্যই পুষ্টিকর খাবার ও প্রচুর পানি পান করতে হবে, ডাক্তারের নিষেধ করা খাবার খাওয়া যাবেনা, পরযাপ্ত পরিমানে ঘুমাতে হবে এবং হাসি খুশি থাকতে হবে। একজন সুস্থ্য মা’ই পারে একটা সুস্থ শিশু জন্ম দিতে ।


Leave a Reply

Your email address will not be published.