রংপুরের গৌরবময় ঐতিহ্য শতরঞ্জি এর চাহিদা শুধু রংপুরেই না সারা বাংলাদেশ এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বললেও ভুল হবে না। নানান রঙয়ের সূতায় বোনা মননশীল এই শিল্প রংপুর জেলার নিসবেতগঞ্জ থেকে সারাদেশে পৌঁছে দিতে এগিয়ে এসেছেন অনেকেই। সেতারা লিলি তাদের মাঝে একজন। সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোশ্যাল সায়েন্স থেকে এম.এস.এস করার পর ব্রাকে চাকুরী নেন। প্রথম সন্তান জন্ম নেয়ার পর বাচ্চা দেখাশোনার জন্য চাকুরী ছেড়ে দেন। শ্বশুর বাড়ি রংপুর জেলার নিসবেতগঞ্জে হওয়ায় শতরঞ্জির সাথে পরিচিতি ছিলো বেশ ভালোভাবেই। বড় ভাইয়ের শতরঞ্জি নিয়ে ব্যবসা দেখে উৎসাহিত হয়ে তিনিও নেমে পরেন শতরঞ্জি বাজারজাত করনে। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি, ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প তাকে নিরাশ করেনি। খুব কম সময়েই তিনি সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে যান। আজ আমরা তাঁর এই পথ চলার গল্প শুনবো। তাঁর আগে জেনে নেই শতরঞ্জির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

ব্রিটিশ শাসন আমলে শতরঞ্জির ব্যবহার ছিলো ব্যপক ভাবে। তৎকালীন অভিজাত পরিবার গুলোতে শতরঞ্জি ব্যবহার হতো মাদুর, পাপোষ, ওয়ালম্যাট , সভা বা জলসায় বসার আসন হিসেবে। মোঘল আমলে আকবরের সময় থেকেই রংপুর জেলার নিসবেতগঞ্জে শতরঞ্জি তৈরি হতো। সম্রাট আকবর নিজেও শতরঞ্জির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এরপর ১৯১২ সালের প্রকাশিত রংপুর গেজেটিয়ারে ইতিহাসবিদ হান্টার উল্লেখ করেন, ১৮৮০ সালে নিসবেত অঞ্চলে শতরঞ্জির নির্মাণশৈলী দেখে মুগ্ধ হন রংপুরের জেলা কালেক্টর। তিনি নিজ উদ্যোগে শতরঞ্জি শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতায় অগ্রসর হন। রংপুর শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে নিসবেতগঞ্জে গড়ে উঠেছে এ শতরঞ্জি পল্লী। ব্রিটিশ শাসন আমলে সমগ্র ভারত, শ্রীলংকা, বার্মা ইন্দোনেশিয়া থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ নানা দেশে প্রচুর শতরঞ্জি রপ্তানি করা হতো। সারা দেশে শতরঞ্জির শেকড় প্রোথিত হয়েছে ১৮৩০ সালেরও আগে থেকে। ভারত বিভক্তির পর শতরঞ্জি শিল্পে সংকট দেখা দিতে শুরু করলেও বর্তমান যুগে আবারো শতরঞ্জির চাহিদা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।। শতরঞ্জি বুননের দিক থেকে আধুনিক ট্যাপেস্ট্রির মতই একটি শিল্প।

আমরা এখন সরাসরি আলোচনায় চলে যাবো, আমাদের সাথে আছেন সেতারা লিলি আপু।

আপু প্রথম থেকে বলুন কিভাবে আপনি এই শতরঞ্জি নিয়ে কাজ শুরু করলেন এবং কেন শতরঞ্জিকেই বেছে নিলেন উদ্যোক্তা হবার জন্য?
সে.তা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এস.এস পাশ করার পর ব্র্যাকে জয়েন করি। ৫ বছর চাকরি করি। প্রথম বাচ্চার জন্মের পর চাকুরী ছাড়তে বাধ্য হই। কারন বাচ্চাকে দেখাশোনা করার কেউ ছিল না। আর আমার বিয়ে হয় রংপুর নিশবেতগঞ্জ শতরঞ্জি পাড়ায়। বিয়ের পর এই শতরঞ্জির সাথে আমার পরিচয়। আমার শশুরবাড়িতে বড় ভাই কাজ করতেন শতরঞ্জি নিয়ে। হঠাৎ চাকরী ছাড়ার পর মনে হত নিজের আত্মপরিচয়ের জন্য কিছু করার দরকার। তখন মাথায় আসল শতরঞ্জির কথা। কারন এটা একটা ঐতিহ্যবাহী পণ্য। আর বৃটিশ আমল থেকেই আমাদের দেশে কারিগররা শতরঞ্জি বুনন করে আসছে। আর পণ্যটা যখন আমি নিজে ব্যবহার করা শুরু করি তখন আরও মুগ্ধ হই। কারন এটা পরিস্কার করা সহজ এবং খুব টেকসই। একটা শতরন্জি ৮/১০ বছর অনায়াসে ব্যবহার করা যায়। গ্রামের ৯০% মহিলা এই বুনন শিল্পের সাথে জড়িত যারা এই কাজ করেই তাদের সংসার চালান। তখন আমার মনে হল, আমি নিজে এটা নিয়ে কাজ করতে পারি অনলাইনে। আমার নিজের জন্য কিছু করার পাশাপাশি এই মহিলা কারিগরদের পাশেও আমি দাঁড়াতে পারব। মুলতঃ এরাই আমার কাজের অনুপ্রেরণা। শতরন্জি তাঁতে বুনন করা হয় মখমল সুতায়, সম্পূর্ণ হাতে বুনন করা হয়। কার্পেট, ফ্লোরমেট, পাপোশ এগুলো মুলত বেশি সেল হয়। মোট ৫ টা সাইজের কার্পেট নিয়ে আমি কাজ করি।

আপনার কাজের সফলতা এখন পর্যন্ত কতটুকু আমরা তা জানতে চাই।
সে.তা প্রথমে ফেইসবুকে একটা পেইজ খুলি “শতরঞ্জি সম্ভার”। পেইজের শুরুতে আমি টুকটাক অর্ডার পেতাম কিন্তু এই করোনায় আমি Women and e-Commerce forum WE গ্রূপে যুক্ত হওয়ার পর ব্যাপক সারা পাই। একমাস বিশ দিনে আমি দুই লাখ টাকার উপরে সেল করি। বর্তমানে এই করোনায় আমি চার মাসে প্রায় ৬লাখ টাকার সেল করি এবং অনেক রিপিট কাস্টমার এখন আমার। আমার শতরঞ্জি অলরেডি চারজন দেশের বাইরে নিয়ে গেছেন। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কাতার এবং আমেরিকায় প্রবাসীরা আমার ক্রেতা হয়েছেন। তাঁরা সেখানে অন্যান্য প্রবাসীদের কাছে আমার প্রোডাক্ট এর রিভিউ দিয়েছে। এটা আমার সফলতার প্রথম ধাপ বলেই আমি মনে করি। আমাকে যেতে হবে আরো অনেক দূর। আমি দেশের ৪২টা জেলায় আমার পণ্য পাঠিয়েছি। আমি চাই ৬৪টি জেলায় আমার পণ্য পাঠাব। বিদেশী কার্পেট এর জায়গায় আমার দেশের পণ্য দিয়ে ঘর মানুষ সাজাবে দেশের পণ্য দেশের মানুষ ব্যবহার করবে। যে পণ্য একসময় রাজা বাদশাহদের দরবারে শোভা পেত তা এখন বাংলার ঘরে ঘরে শোভা পাবে।

কাজের ক্ষেত্রে কোন বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো কি? কিভাবে তা কাটিয়ে উঠেছেন?
সে.তা কাজের ক্ষেত্রে বাঁধা মুলতঃ ডেলিভারি সমস্যা। পণ্যের ডেলিভারি করতেই আমাদের অনলাইন ব্যবসায়ীদের বেশি সমস্যা। বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায় না। নিজস্ব ব্যবসায় প্রথমে ডেলিভারি দিলেও বর্তমানে কিছু অনলাইন ডেলিভারি সার্ভিসের মাধ্যমে চলছে আমার ডেলিভারি। তবে এক্ষেত্রে আমার স্বামী আমাকে সর্বোচ্চ সহায়তা করে। এমনকী অফিস শেষে ও নিজেও ডেলিভারি দিয়েছে। কাজে ১০০% সহযোগীতা পাই আমি পরিবার থেকে।

নতুনদের জন্যে কিছু পরামর্শ দিন যারা আপনার মত সফল উদ্যোক্তা হতে চায়।
সে.তা নতুনদের জন্য একটা কথাই বলব মন থেকে যদি কোন কাজ করেন, আর কাজে সততা আর আস্থা থাকে একসময় ঠিকই আপনার লক্ষ্যেে পৌছাতে সক্ষম হবেন। তবে এখন অনলাইনে প্রচুর পেইজ যারা একই ধরনের কাজ করে থাকে।কিন্তু আপনার কাজই আপনার সফলতা কে তুলে ধরবে। আপনি যদি কাজটাকে সততার সাথে চালাতে পারেন আপনাকে আর পিছন ফিরতে হবে না।
সেতারা লিলি আপু আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনার মুল্যবান সময় থেকে সময় বেড় করে আমাদের সাথে আপনার সফলতার গল্প শেয়ার করার জন্য। আশা করছি আপনি নতুন উদ্যোক্তাদের দৃষ্টান্ত হবেন এবং আপনাকে দেখে নবীনরা আরোও অনেক বেশি সাহস পাবে, উৎসাহিত হবে। আপনার সার্বিক মঙ্গল কামনা করছি এবং আপনার উদ্যোগের জন্য, আপনার সফলতার জন্য জানাই প্রান ঢালা আভিনন্দন। পাঠক আপনারা যদি রংপুরের বাহারি শতরঞ্জি নিজের কালেকশনে রাখতে চান তাহলে শতরঞ্জি সম্ভারে যোগাযোগ করুন।