২০১৭ সালে “বিশ্ব লেখক কল্যান সংস্থা” থেকে নওশীন যখন “রংপুরের কৃতি সন্তান” এ্যাওয়ার্ড টি পান তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ২২ বছর । এই কম বয়সেই তিনি নিজ প্রচেষ্টায় শিশুদের নিয়ে আয়োজন করে গেছেন বিভিন্ন ইভেন্টের । সময়ের সাথে সাথে তিনি শুধু শিশুদের জন্যই নয় রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস করার সুবাদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সমাজের অস্বচ্ছল পরিবার গুলোর দিকে । কখনও বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে , কখনও একা। আমরা তার সাথে কিছু সময় কাটিয়ে জানতে চেয়েছি তার প্রচেষ্টা , সফলতা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে । সে কথাগুলোই আপনাদের সাথে শেয়ার করবো এখন-
আপু শিশুদের নিয়ে আপনি কি টাইপের ইভেন্ট করতেন? এসব ইভেন্টের পেছনে মূল উদ্দেশ্যটা কি ছিলো?
ন. তা. আমি আসলে ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করতাম। ছবি আঁকার প্রতি আমার বেশ আকর্ষণ ছিলো ।ছোটবেলা থেকেই আমি যেকোনো ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় প্রথম হতাম। যখন কলেজে উঠলাম তখন খেয়াল করলাম,যেসব বাচ্চারা মানে মধ্যবিত্ত পরিবারের বা সুবিধা বঞ্চিত শিশুরা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ছবি আঁকা শেখেনি, তারা এই টাইপের প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহন করতে সঙ্কোচ করতো, কিন্তু তাদেরও প্রবল ইচ্ছা ছিলো যে, আমিও কিছু করি,আমিও পুরুস্কার পাই। আমার মনে হতো ওরা তো প্রাপ্তির আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, আমার খারাপ লাগতো। ওদের চাওয়া পুরন করতেই আমি বিজয় দিবসে ছবি আঁকার প্রতিযোগিতার আয়োজন করি সম্পূর্ণ নিজের উদ্দ্যগে । সেখানে চ্যানেল আই এর রিপোর্টার মেরিনা লাভ্লী প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন।এতোগুলো বাচ্চা যে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিবে আমি নিজেও আশা করিনি! সুবিধা বঞ্চিত শিশুও এতে অংশ গ্রহন করেছিলো । বাচ্চাদের আনন্দ দেখার মতো ছিলো । এছারাও আমি এলাকার বাচ্চাদের নিয়ে প্রতি বছর ওদের স্বরচিত কবিতা, ধাঁধা , কৌতুক নিয়ে দেয়াল পত্রিকা “কিংকর্তব্যবিমূঢ়” তৈরি করতাম। প্রথম বারেই এলাকার সবার কাছে এতো বেশি সাড়া পেয়েছিলাম যে আমাকে প্রতি ইংরেজি বছরের প্রথম দিনে দেয়াল পত্রিকার আয়োজন চালিয়ে যেতে হয়েছিলো। পরে অবশ্য শুধু বাচ্চারা না বাচ্চার মা , বড় বোনরাও এতে অংশ গ্রহন করতো। এরপর আমি বাচ্চাদের নিয়ে বৃক্ষ রোপন অভিযানও করেছিলাম। এই অভিযানের আমার মূল উদ্দেশ্য ছিলো বাচ্চাদের গ্লোবাল ওয়ার্মিং থেকে বাঁচার একটা অন্যতম উপায় যে গাছ লাগানো সেটা বোঝানো। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় এসব ইভেন্ট আয়োজন করার আর সময় পেতাম না, কিন্তু কিছু না কিছু করতে ইচ্ছা করতো সব সময়।
আপু আপনি বাচ্চাদের নিয়ে এতো কিছু আয়োজন করেছেন, বড়দের জন্য কিছু করতে ইচ্ছে করেনি?
ন. তা. আসলে মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় পড়ালেখা নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকতাম যে আর বাচ্চাদের নিয়েই সাংস্কৃতিক ইভেন্ট করার সময় পেতাম না , এইদিকে আসলে আর আগানো হয়নি ।। বড়দের নিয়ে কিছু করার কথা কখনও মাথায় আসেনি।
আপনার একটা স্বেচ্ছাসেবী গ্রূপ আছে “স্পন্দন” । মূলত কি টাইপের সেবা দেয়া হতো এই গ্রূপের মাধ্যমে?
হ্যা “স্পন্দন” আমার একটা ননপ্রফিট অর্গানাইজেশন ।এর মাধ্যমে আমরা অসহায়, সুবিধাবঞ্ছিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো , তাদের কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা , শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়া, ফ্রী মেডিকেল কাম্পেইন, ব্লাড ডোনেশন এবং ব্লাড ম্যানেজ করে দেয়ার চেষ্টা, অসুস্থ রোগীর চিকিৎসার জন্য সাহায্য করা, ফ্রী কম্পিউটার প্রশিক্ষন এর ব্যবস্থা করা, বন্যা দুর্গত মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ানো , শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো এসব সেবা দেয়া আমাদের লক্ষ্য ছিলো। সুহা শরীফ আমার বান্ধবী এইসব কাজে অনেক হেল্প করতো ,আমাকে ফেসবুকে একটা গ্রূপ খুলে দিয়েছিলো কাজের সুবিধার জন্য। আমরা শীতার্তদের মাঝে শীত বস্ত্রও বিতরন করেছি। এখন বন্ধুদের সাথে তেমন যোগাযোগ নেই, সবাই যে যার কাজে ব্যাস্ত, তাই এটা নিয়ে আর কাজ করা হচ্ছেনা।
আপনি এখন মানুষের জন্য কি করছেন?
করোনার কারনে কিছুই করতে পারছি না। করোনার আগে আমার কলেজের জুনিয়র নওরীন আফরোজ আর এক বন্ধু আদিতা বুশরার সাহায্যে গনেশপুরে দুঃস্থ মানুষদের মাঝে ফ্রী মেডিক্যাল চেক আপ ক্যাম্পিং করেছি। চেষ্টা করেছি যতটুকু পারা যায় ফ্রী ওষুধ দিতে। বিভিন্ন অর্গানাইজেশনের সাথেও ফ্রী মেডিক্যাল চেক আপ ক্যাম্পিং করেছি । ভবিষ্যতে এরকম ফ্রী ক্যাম্পিং একক ভাবে বা কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে আরও করার ইচ্ছা আছে।

কাজ করতে যেয়ে কখনও বাঁধার সন্মুখিন হয়েছেন?
আল্লাহ্র রহমতে প্রতিটা কাজই সুন্দর ভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি। শুধু মনে আছে বৃক্ষ রোপন অভিযানের সময় বাচ্চারা যখন সবাই কে ফ্রী গাছ বিতরন করছিলো তখন অনেক বড় মানুষরাই এটাকে ভুল ভাবে নিয়েছিলো,ওরা ভেবেছিলো আমরা এর বিনিময়ে টাকা নিবো। বাচ্চারা খুব মন খারাপ করেছিলো। পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছিলো সবাই এটা সবাইকে ফ্রী দেয়া হচ্ছে। সেদিন বৃক্ষ রোপন দিবস ছিলো তাই সবাইকে বোঝাতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। আর একবার আমাদের দেয়াল পত্রিকা কে বা কারা চুরি করে নিয়ে যায়। বাচ্চারা খুব কষ্ট পেয়েছিলো । আবার বাচ্চাদের নিয়ে করা কাজগুলো স্পন্সর করার মতো কেউ ছিলো না, নিজের গাটের পয়সা খরচ করে করতাম, তাই আশানুরুপ ভাবে বড় করে কিছু করতে পারিনি। অবশ্য যা করেছি আলহামদুলিল্লাহ , সবাই খুশি ছিলাম আমরা।
কাজ করতে যেয়ে কোন মজার স্মৃতি আছে ?
আসলে এই কাজের সময়গুলো পুরোটাই আমার কাছে খুব মজার খুব আনন্দের, পুরো দিনটাই হেসে খেলে পার হয়ে যায়। আমাদের দেয়াল পত্রিকা দেখে বিশ্ব লেখক কল্যান সংস্থার সদস্য আনোয়ার হোসেন শিশির আমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমার বাসায় চলে আসে। আমাকে জিজ্ঞেস করে, এটা তুমি বানিয়েছো? আমি বললাম, জ্বি। তারপর উনি সব বাচ্চাদের সাথে দেখা করলেন আর বললেন, ছড়া লিখেছো, কিন্তু কেউ কি ছড়া আবৃত্তি করতে পারো? সবাই বলল যে না আমরা তো পারিনা, তখন উনি সবাইকে ফ্রী ছড়া আবৃত্তি আর গান শেখানোর দায়িত্ব নিলেন।প্রতি শুক্রবার তিনি বাচ্চাদের কবিতা আবৃত্তি আর গানের ক্লাশ নেয়া শুরু করেছিলেন।এটা বাচ্চাদের জন্য একটা প্রাপ্তি ছিলো।

কে আপনার কাজে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ যুগিয়েছে?
আমার মা। আমার মা কখনই আমাকে কোন কাজে বাঁধা দেয়নি। বরং সব সময় উৎসাহ দিয়েছেন। আমার বোনরাও আমাকে সাহায্য করেছে সব সময় আর উৎসাহ তো দিয়েছেই।
আপনার প্রাপ্তিগুলো যদি আমাদের বলতেন?
আসলে ছবি আঁকাআঁকির সাথে আমি অনেক বেশি সম্পৃক্ত ছিলাম। প্রাপ্তিগুলো ওই সেকটর থেকেই বেশি। টানা চার বছর শিশু একাডেমির স্বাধিনতা দিবস,বিজয় দিবস, শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসের সবগুলো ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছি। যদিও আমি শিশু একাডেমি থেকে ছবি আঁকা শিখিনি। এরপর ইউনিসেফ থেকে “মিনা দিবসে” অঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছি। বেগম রোকেয়া দিবসে বেগম রোকেয়া ফোরাম কর্তৃক আয়োজিত অঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছি। জাতীয় পর্যায় স্কেচ অংকন প্রতিযোগিতায় দ্বিতিয় হয়েছি, অস্ট্রেলিয়া “save the children” প্রোগ্রাম কর্তৃক আয়োজিত ছবি আঁকার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় দ্বিতিয় হয়েছি, এছারাও দৈনিক সমকাল আয়োজিত প্যাস্টেল রং এ ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছি, দৈনিক সমকালে আমার ছবিও এসেছিলো, চ্যানেল আই কর্তৃক আয়োজিত আঁকা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছি। আরও অনেক পুরুস্কার পেয়েছি ছবি আঁকার জন্য। আর শিশুদের জন্য নিজে স্পন্সর হয়ে ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা আয়োজন, দেয়াল পত্রিকা তৈরি এবং বৃক্ষ রোপণ অভিযানের জন্য বিশ্ব লেখক কল্যান সংস্থা থেকে “রংপুরের কৃতি সন্তান” এ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। দৈনিক যুগের আলো পত্রিকায় আমার আয়োজিত প্রতিযোগিতার ছবিও এসেছিলো।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ নওশিন তাবাসসুম আপু আপনার মুল্যবান সময় থেকে আমাদের সময় দেওয়ার জন্য। আমরা আশা করছি আপনি সমাজের দুঃস্থ অসহায় মানুষদের জন্য আরোও সেবা দিয়ে যাবেন, ডাক্তারি আপনার মহৎ পেশা একে , এটাকে কাজে লাগিয়ে আপনার মানব সেবা মুলক কাজ গুলো আরও অগ্রসর হবে এই কামনা করছি। প্রিয় পাঠক আশা করছি আপনারা যদি সমাজের শিশুদের জন্য, দুঃস্থ মানুষদের জন্য কিছু করতে চান তাহলে নওশিন আপুর কাছ থেকে অনুপ্রানিত হবেন । আপুর সাথে আপনারাও সামনে এগিয়ে যাবেন এই সঙ্কল্পে “ যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে।”
Good wishes go ahead