পুরো বাংলাদেশে বগুড়ার দই সরবরাহ করছেন সাবিহা বিন্তে বেলাল


বগুড়ার দই একবার যে চেখে দেখেছে সারা জীবনে তাঁর অন্য কোন জায়গার দই মুখে রুচবে না। কোন এলাকা কে ছোট করে দেখাবার জন্য নয়, সত্যটাই এমন। বগুড়ার দই যেমন মিষ্টি তেমন স্বাদে অতুলনীয়। বগুড়ার দই এর মতো লালচে ভাব আনার জন্য অনেকেই চিনির সিরা বাদামী করে মিশিয়ে থাকেন, কিন্তু কাকের পিঠে ময়ূরের পাখনা লাগালেই কি আর কাক ময়ূর হয়ে যায়? যারা একবার হলেও বগুড়ার দই খেয়েছেন তারাই শুধু বুঝবেন, একটুও বাড়িয়ে বলা হচ্ছে না। সেই দই এত দিন টাটকা খাবার পরিধি ঢাকা অব্দি সীমিত ছিল, কিন্তু সাবিহা বিন্তে বেলাল  সেই টাটকা দই পৌঁছে দেয়ার দাবী করছেন একই স্বাদে। নষ্ট হলেই মুল্য ফেরত দিবেন এমনও জানিয়েছেন তিনি। সরাসরি বগুড়া থেকেই দই সংগ্রহ করেন তিনি। তেজগাঁ কলেজ থেকে এম এস এস করেন তিনি, এরপর একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা হিসেবে কাজ শুরু করেন ২০১৬ সালে। কিন্তু স্বপ্ন ছিলো উদ্যোক্তা হবার তাই চাকুরী ছেড়ে নেমে পরেন ব্যবসার জগতে। বর্তমানে তিনি বগুড়ার দই এর পাশাপাশি ঘি, সরিষার তেল এবং মধু নিয়েও কাজ করছেন। আজ আমরা বগুড়ার মেয়ে সাবিহা বিন্তে বেলাল এর মুখে শুনবো বগুড়ার দই নিয়ে তাঁর উদ্যোক্তা হবার গল্প, সেই সাথে জেনে নিবো কিভাবে তিনি আমাদেরসরাসরি বগুড়ার দই  ৬৪ জেলায় পৌঁছে দিবেন। শুরু করছি আলোচনা পর্ব।

 

স্বামীর সাথে সাবিহা বিন্তে বেলাল

আপু আপনি বগুড়ার দই নিয়ে কবে থেকে কাজ করছেন?

বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী দই

 উদ্যোগের জার্নিটা শুরু হয় ২০১৫সাল থেকে। বগুড়ার মেয়ে বলে সবাই বলতো আপু /ভাবী বগুড়ার দই খাওয়ান, অনেক বিখ্যাত খুব সুনাম বগুড়ার দই এর। ঐতিহ্য নিয়ে সবাই বলাতে অনুপ্রেরনা হতো গর্বও হতো কারন আমি বগুড়া জেলায় জন্ম নিয়েছি। সবাই আমার জেলার ঐতিহ্যকে চিনে কিন্তু তার অরিজিনাল স্বাদটা সব জেলায় অদৌ পৌঁছাতে পারছেনা এটা ভেবে খুব খারাপ লাগতো। আস্থা বিশ্বাসের চ্যালেন্জ নিয়ে নিজের ইচ্ছাশক্তি কাজে লাগিয়ে জেলার প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান থেকে দই নিয়ে কাজ করার উদ্যোগ হাতে নিই। যেহেতু টিচিং এর পাশাপাশি উদ্যোগটা হাতে নিয়েছিলাম সেই পরিচিতির সূএ ধরে প্রতিবেশী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের  অনুপ্রেরণায় উৎসাহ  পেয়েছিলাম আর সেই মনোবল থেকেই উদ্যোগ বড় করার স্বপ্ন দেখতাম।  মাঝে উদ্যোগের ব্যাপক পরিচিতি ও পরিধি বিস্তার কিভাবে হবে, কি ভাবে কাজ করলে এগিয়ে যাবো হতাশার কারণে  বুঝতে পারছিলাম না। তারপর ২০২০সালে করোনায় যখন গোটা বিশ্ব মহামারীর কবলে সেই সময়টা দেখা পায় Women and e-commerce(WE) গ্রূপ এর। গ্রুপে জয়েন করার পর সবার পোস্ট পড়ে অনেক অনুপ্রেরণা পেতাম যা  উদ্যোগের  প্রথম অবস্থায় বিষয়গুলো নিয়ে খুব হতাশায় ছিলাম আর গ্রুপেই নতুন করে আবার আশার আলো দেখতে পাই সাথে ছিলো নিজের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল, এরপর শেষ থেকে আবার শুরু করার চেষ্টা করি। প্রতিনিয়ত লেগে থাকার চেষ্টা ও পরিবারিক সাপোর্ট এ এতটা দূর এগিয়েছি সামনে আরোও এগিয়ে যেতে চাই।

বগুড়ার দই

বগুড়ার দই নিয়ে কাজ করতে যেয়ে ক্রেতাদের কাছে কেমন সাড়া পাচ্ছেন?   

এক্ষেত্রে আমি বলতে চাই বগুড়ার দই ঢাকাতে প্রচুর চাহিদা থাকায় আলহামদুলিল্লাহ ক্রেতা থেকে ভালো সাড়া পেয়েছি। এই পর্যন্ত দই এর ক্রেতা ৫০ এর বেশী এবং রিপিট কাস্টমার ২০ জন। শুধু একটি গ্রূপেই আমার সেল আপডেট ৩৩হাজেরর উপরে। আসলে যারা ভোজন বিলাসী তারা অরিজিনাল পন্যটাই চায়। আর আমরাও অরিজিনাল পন্য দেওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।এজন্য সম্মানিত ক্রেতাগনও আমাদের উপর আস্থা রাখে এবং আমরাও সম্মানিত ক্রেতাগনের কাছে অরিজিনাল বগুড়ার দই পৌঁছে দিয়ে থাকি।আমাদের শ্লোগান “বিশ্বাসই অর্জন খাঁটি পণ্যের আস্থা ভাজন।”

কাজ প্রসারিত করতে আপনি কি ভবিষ্যত পরিকল্পনা করেছেন আমরা জানতে চাই।

আমার উদ্যোগ আমার স্বপ্ন। যেহেতু শখে না কিছু করবো এই মনোবল অটুট বিশ্বাস ও ইচ্ছাশক্তি থেকে উদ্যোগ হাতে নেওয়া। কাজকে সম্মান ও ভালোবেসে এত দূর আসা।কাজকে প্রসারিত করতে আমি প্রতিনিয়ত আমার উদ্যোগের সাথে চ্যালেঞ্জ করে স্বপ্ন দেখি ইনশাআল্লাহ ভালো কিছু করবো। আমার স্বপ্ন পূরণে সাপোর্ট হয়ে সবসময় হাসবেন্ড, বাবা,মা ও দেবরকে পাশে পেয়েছি তারা না থাকলে আমার এই যাত্রা সফল হতো না। ভবিষ্যত পরিকল্পনায় তারাও আমার সামিল। ভবিষ্যতে অফলাইনে স্থায়ী ঠিকানা ও সফলভাবে দূরের জেলাগুলোতে বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী খাঁটি দই পৌঁছে দেওয়া। সর্বশেষ আমি বলতে চাই ভেজালমুক্ত খাটি বগুড়ার দই দেশবাসীর জন্য সরবরাহ করে জাতির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়া একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

পরিবারের সাথে সাবিহা

কাজের ক্ষেত্রে কি কি বাধার সম্মুখীন আপনাকে হতে হয়েছে? কিভাবে সমস্যা গুলো সমাধান করেছেন?

প্রথম অবস্থায় কাজের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবেই বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম।যেহেতু অফলাইনে থেকে অনলাইনে আসা তাই মার্কেটিং,পন্য স্টক, ক্রেতার কাছে কি ভাবে পন্য পৌঁছাবো, টাকা পেমেন্ট, প্যাকেজিং, দই এর গুনাগুন মান কতটা ক্রেতার কাছে প্রাধান্য পাবে সবকিছু মিলিয়ে খুব সমস্যায় ছিলাম তবে মনে অটুট বিশ্বাস ছিলো লেগে থাকলে ইনশাআল্লাহ পারবো।সমস্যার সমাধান বলতে বলবো নিজের কায়িক পরিশ্রম,সাধনা ও চেষ্টা। এটা নিয়ে পরিবার সাপোর্ট ও ডিজিটাল স্কিল ফর বাংলাদেশের মতো গ্রুপ যেখানে সম্মানিত রাজিব স্যারের পরামর্শগুলো খুবই কাজে দিয়েছে। গুগল সার্চ করেও বারবার জানা ও শেখার চেষ্টা করেছি। সততা ও সৎ পথে থেকে যেহেতু স্বপ্নের লড়াইটা ছিলো তাই তখন পন্যকে সামনে রেখে টাকা ফিডব্যাক দেওয়ার চ্যালেন্জ গ্রহন করি এবং তাতেও সফলতা অর্জন করি।

বগুড়ার দইয়ের স্বর বা উপরের আস্তরন যা খেতে অনেকটা দুধের ক্ষিরসার মতো

অনেকেই চিনির সিরা মিশিয়ে দই এর রং পরিবর্তন করে বগুড়ার দই বলে বিক্রি করে, এক্ষেত্রে বগুড়ার আসল দই চেনার উপায় কি?

হ্যাঁ এক্ষেত্রে আমি একমত।অনেকেই অসৎ উপায়ে ঘরে তৈরী করছে এবং অসাধু ব্যবসায়ীর মাধ্যমেও কাজটা হাসিল করছে বগুড়ার ঐতিহ্য সুনাম নষ্ট করার জন্য।তবে ক্রেতা একটু সচেতন হলে অরিজিনাল বগুড়ার দই চেনা সম্ভব। এক্ষেত্রে আমি বলবো সহজেই কিভাবে ভেজালমুক্ত খাটি বগুড়ার দই চিনতে পারবেনঃ-

বগুড়ার দই প্রথমত সহজ ও সবচেয়ে চেনার উত্তম উপায় হলো এটার উপরে হালকা লেয়ার সর পড়বে। চিনির সিরা মিশালে এই সরটা কখনোই পড়বে না। পড়লেও সেটা পাতলা টাইপের হবে। 

খাটি দই এর সর খেতে কিছুটা ক্ষীরসার মতো হবে। 

অরিজিনাল বগুড়ার দইয়ের রং কখনোই গাড় বা খেয়ারী বর্নের হবে না।খাটি গাভীর দুগ্ধ জ্বাল করে যে রং ধারন করে সেই রং টায় দই বর্ন হবে।

চিনির সিরা মিশালে দই থেকে প্রচুর পানি কাটবে যা অরিজিনাল দইয়ে কখনোই পানি কাটবে না। 

বগুড়ার দই সাধারণত ভারী আঠালো ও ঘন হয় যা সরা উপুর করলেও পড়ে না কিন্তু চিনির সিরা মিশালে এটা ঘোলাটে পাতলা হবে। 

সর্বশেষ আমি যা বলতে চাই বগুড়ার দই মানে, স্বাদে ও ঘ্রানে কোয়ালিটিপূর্ন যা অন্যন্যা জেলার তৈরিকৃত দই থেকে সম্পূর্নই আলাদা। বগুড়ার দই এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য বগুড়া জেলার আবহাওয়া যা যুগ যুগ ধরে বগুড়া জেলার সুনাম ও ঐতিহ্য বহন করে আসছে।

বগুড়ার দই কোথায় থেকে সংগ্রহ করছেন?

বগুড়া জেলার দইয়ের যারা সুদক্ষ কারিগর দেশী গাভীর খাঁটি দুধ সংগ্রহ করে অত্যন্ত যত্নের সাথে বগুড়ার ঐতিহ্যের মান অক্ষুণ্ণ রেখে দই প্রস্তুুত  করে তেমনি  জনপ্রিয় ব্যান্ড থেকে দই সংগ্রহ করে থাকি যা বিএসটিআইয়ের অনুমোদিত ও কারখানাটি আইএসও সদনপ্রাপ্ত।

বগুড়ার দই সরাসরি ৬৪ জেলায় পৌঁছে দেওয়া একটা বড় চ্যালেঞ্জ, এই পরিকল্পনাটা কিভাবে বাস্তবায়ন করছেন?

প্রথম অবস্থায় এটা নিয়ে খুবই সমস্যায় ছিলাম যেহেতু কোনভাবেই কুরিয়ারে দই দেওয়া সহজ ছিলো না এতে দই এর গুনগুনগত মান নষ্ট  হয়ে যায়। অপরপক্ষে ক্রেতা থেকেও ভালো সাড়া পেয়েছিলাম কিন্তু ঢাকার বাহিরে হওয়ায় অন্যন্য জেলায় দই পৌঁছানোটা খুব সহজ ছিলো না। কারন এটা অনেক কষ্টসাধ্য ও ব্যায়সাপেক্ষ ছিলো। উদ্যোগের শুরুতেই হতাশার সম্মুখীন হলাম পরিবারের সাপোর্ট পেয়ে একটা চ্যালেন্জ নিলাম। এরপর খোঁজ শুরু করলাম কিভাবে খাবারের মান অটুট রেখে অন্য জেলায় তা সরবরাহ করা যায়। পেয়েও গেলাম এমন একটি মাধ্যম। প্রথম অবস্থায় বিভিন্ন জেলায় পরিচিত আমার কিছু আত্নীয় স্বজনের কাছে দই পাঠালাম ম্যানি ফিডব্যাক চ্যালেন্জ নিয়ে এবং সম্মানিত ক্রেতাগন থেকে ভালো রিভিউ আমার কাজের আগ্রহ ও অনুপ্রেরণায় সৎ সাহস সফলতা অর্জন করি।তারপর থেকেই বগুড়ার প্বার্শবর্তী জেলা ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে বগুড়ার দই পৌঁছাতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ। চট্রগ্রাম থেকেও ২জন কাস্টমার পেয়েছি যারা বগুড়া দই খেয়ে সুনাম করেছে। তাদের এই আস্থা, দোয়া ও ভালোবাসায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি।

আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ আপু, আপনি সত্যিই অনেক বড় একটা উদ্যোগ নিয়েছেন যা অবশ্যই প্রশংসা যোগ্য। বগুড়ার খাঁটি দই আপনার মাধ্যমে ছড়িয়ে যাক বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মানুষের ঘরে ঘরে। আপনার জন্য রইলো অনেক অনেক শুভ কামনা। প্রিয় পাঠক আপনারা বাংলাদেশের যে প্রান্তে বসেই এই লেখাটি পড়েন না কেন, বগুড়ার মিষ্টি দই খেতে ইচ্ছে করলে যোগাযোগ করুন Jannat Food Valley তে।


Leave a Reply

Your email address will not be published.