নাটোরের বিলের মাছ ভাগ্য ফেরালো শিউলি ইসলামের


নাটোরের হালতির বিলকে বলা হয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন এর অভয়ারণ্য। বিলে পানি দীর্ঘ্যস্থায়ী হওয়ায় মাছের পোনার অভাব নেই, তাই মাছের স্বর্গ রাজ্যে পরিনত হয়েছে হালতির বিল এবং চলন বিল। এই বিলের তাজা মাছের জনপ্রিয়তা দেশ জুড়ে। ডিজিটাল মার্কেটিং এর সুবাদে অনেকেই এখন বাসায় বসেই এইসব বিলের মাছ পেয়ে যাচ্ছেন ক্রেতারা, অন্যদিকে জীবন পরিবর্তন করছেন উদ্যোক্তারা। নাটোরের আশাবাদী তরুণদের জন্য বেশ জনপ্রিয় একটি উদ্যোগ নাটোরের বিলের মাছ নিয়ে অনলাইনের মাধ্যমে সারা দেশে বাজারজাত করা। তেমনি এক নাটোরের উদ্যোক্তা শিউলি ইসলাম তালুকদার কাজ করছেন হালতির বিল, চলনবিল, পাটুল বিল, কাজিপুর বিলের মাছ নিয়ে। পাশাপাশি আরোও অনেক উদ্যোগ তিনি নিয়েছে যা আমরা ক্রমান্বয়ে তা  জানতে পারবো। এই ব্লগ থেকে আপনি জানতে পারবেন কিভাবে এক সংগ্রামী নারী তার প্রবল ইচ্ছাশক্তি এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে মাত্র দুই মাসেই বনে গেছেন লাখপতি। আশা করছি নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য এই আলোচনা একটি পাথেয় হবে এবং আপনারাও পেয়ে যাবেন এক রাশ অনুপ্রেরণা। আমরা চলে যাচ্ছি মূল আলোচনা পর্বে, সাথে আছেন শিউলি ইসলাম তালুকদার আপু।

আপু আপনি তো অনলাইনে নানাবিধা পণ্য নিয়ে কাজ করছেন এবং সফলতাও পেয়েছেন, নাটোরের চলন বিলের মাছ নিয়ে কাজ কবে থেকে শুরু করেছেন?

এক ছোটবোনের মাধ্যমে ওমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম উইতে এড হই। ওখান থেকে আমি পেয়ে যাই এক ভিন্নধর্মী আইডিয়া। গ্রোসারি করার পরিকল্পনা চলে আসে আমার মাথায় আর আস অনলাইনে হোমমেড ক্যাটারিং সার্ভিস করার পরিকল্পনা। শুরু করে দেই নাটোরের বিলের মাছ নিয়ে আমার গ্রোসারি। কেতু নাটোর হচ্ছে বিলের এলাকা দেশের প্রধান বিলগুলো ঘেরা নাটোরে। হালতির বিল, চলনবিল, পাটুল বিল, কাজিপুর বিল সব ঘিরে আছে নাটোর।এবং নাটোরের মাছ সারা বাংলাদেশে অত্যন্ত প্রিয় কারণ এটা হচ্ছে মিষ্টি পানির মাছ। ভাবলাম আমি এই মাছগুলো সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করব। অনলাইনে পেজ খুলে ফেললাম গ্রোসারীর। নাম দিলাম ইশিনা গ্রোসারি। আমার টার্গেট হলো দেশি হারিয়ে যাওয়া বিলুপ্তপ্রায় মাছ গুলোকে যেগুলোর সম্পূর্ণ ফরমালিন মুক্ত একেবারে বিল থেকে ধরা সে গুলোকে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া।প্রথমত আমি এটাকে টার্গেট করি শুধুমাত্র ঢাকার ভেতরে ডেলিভারি দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি না চিনি না বিল, না চিনি বিলে যাওয়ার পথ, না চিনি এলাকার লোকজন কে, না চিনি জেলেদেরকে, না চিনি মাছ কাটা ধোয়ার মেয়েদেরকে। প্রচন্ড রকমের ধৈর্য্য নিয়ে আমি এর ওর কাছে জিজ্ঞেস করে যতটুকু জানতে পারি ততটুকু নিয়ে এগোতে থাকি। উইতে আমার কয়েকটা পোস্ট দেই । কিন্তু কয়েকটা পোস্ট দেওয়ার পরে এবং প্রথম ডেলিভারি কমপ্লিট করার পর এই দ্বিতীয় বার আমার কাছে দ্বিগুণ পরিমাণ অর্ডার আসে। আর আমিও এই দশটা দিন পুরোপুরি ছুটতে থাকি বিল এলাকায়। লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা, জেলেদের সঙ্গে কথাবার্তা, মাছের আড়তে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা, বিলের ধারে তৈরি করার শুটকি তার মহাজন সঙ্গে রীতিমতো বসে থেকে সাক্ষাৎকার নিয়ে শুরু করি। ফলে নিজের কাজটা কিছুটা সহজ হয়। এরপর থেকে প্রচুর সারা পাই সারা দেশ থেকে। মাছ নেওয়ার জন্য নওগাঁ রাজশাহী বগুড়া পাবনা চিটাগং সিলেট কুমিল্লা যশোহর নড়াইল বিভিন্ন জায়গা থেকে আমার মাছের অর্ডার আসতে থাকে এবং আমার গ্রোসারীতে সেইসাথে দেশি মুরগি দেশি হাঁস দেশি মুরগির ডিম হাঁসের ডিম বিভিন্ন রকমের ফরমালিনমুক্ত তাজা টাটকা শাকসবজি খেজুরের গুড় আখের গুড় ঘি নাটোরের বিখ্যাত সব কাঁচা ছানার মিষ্টি কুমড়ো বড়ি চালের গুড়া সমস্ত কিছু অর্ডার আসে আমার কাছে।

ইশিনা গ্রোসারীর পন্যের একাংশ

যা আমার কাছে ছিলো আমার কল্পনারও অতীত। আমার মনে হয় এটা হয়েছে শুধুমাত্র উই এর প্ল্যাটফর্ম এর জন্য। আমি যদি উইতে অ্যাড না হতাম দেশি পণ্যের প্রচারণা নিয়ে এত কিছু না পড়তাম দেশি পণ্য সম্পর্কে এত কিছু না জানতাম তাহলে হয়তো আমি কখনোই কল্পনাই করতে পারতাম না দেশি লাইভস্টক পণ্য নিয়ে কাজ শুরু করার।

নাটোরের মাছ সরাসরি বাংলাদেশের প্রত্যেকটা জেলায় পৌঁছে দেওয়া একটা চ্যালেঞ্জ, কিভাবে তা বাস্তবায়ন করছেন?

নাটোরের চারপাশে যে জেলাগুলো থেকে আমার অর্ডার এসেছে সেগুলো চেষ্টা করেছি নাটোর থেকেই কমপ্লিট করার। ঢাকার গুলো সব এটুকু প্রসেসিং করে তারপর নিয়ে এসে ডেলিভারি দিয়েছি। আগের সপ্তাহে একদিন নাটোরের যেতাম সব অর্ডার কমপ্লিট করে 24 ঘন্টা ফ্রিজিং করে পরের দিন এসে ডেলিভারি দিয়ে দিতাম কিন্তু এখন এমন অবস্থা হয়েছে প্রতিদিন আমার মিনিমাম ৮ থেকে ১০ টা করে অর্ডার আসছে। আমি এখন প্রতি সপ্তাহে দেড় থেকে দুই মণ ছোট-বড় মাছ এর অর্ডার কমপ্লিট করছি আলহামদুলিল্লাহ। আমার ইসিনা গ্রোসারির পথচলা শুরু হয়েছে দুই মাস। এরই মধ্যে ৫ মণের কাছাকাছি মাছের অর্ডার কমপ্লিট করেছি। ১ মণের বেশি দেশি মুরগির অর্ডার কমপ্লিট করেছি, আধা মণের মত দেশি হাঁস ও রাজহাঁস অর্ডার কমপ্লিট করেছি। প্রায় বিশ জনের মত দেশি মুরগির ডিম অর্ডার কমপ্লিট করেছি।সাথে আছে বিভিন্ন রকমের সবজি নাটোরের মিষ্টি, ঘি, খেজুরের গুড়, চালের গুড়া, ডালের বড়ি, দেশি গরুর দুধ। 

নাটোরের কাঁচা গোল্লা, সন্দেশ, মিষ্টি

খুব শিগগিরই আমি নাটোরে অফিস নেওয়ার পরিকল্পনা করেছি। কারন আমার পক্ষে একা এত অর্ডার কমপ্লিট করা সম্ভব হচ্ছে না। অফিস নিয়ে দুজন লোক নেওয়ার পরিকল্পনা করেছি এবং একটি ফ্রিজিং গাড়ি কেনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে আমার গ্রোসারির জন্য। যার মাধ্যমে আমি সারা দেশে আমার হালতিবিল চলন বিলের মাছ প্রত্যেকের অর্ডার মাফিক পৌঁছে দিতে পারি। চলন বিলের শুটকির ও প্রচন্ড চাহিদা রয়েছে আমার গ্রোসারীতে। এখানে বিল থেকে মাছ তুলে নিয়ে বিলের ধারে কাটা ধোয়া প্রসেসিং করা সবকিছু করে শুটকি করা হয় যা সারা দেশে মানুষের কাছে দেশি শুটকির কারখানা হিসাবে অত্যন্ত প্রিয়। এখন আমার এমন অবস্থা হয়েছে আমি গাড়িতে যাওয়া যেতে আসা অবস্থাতেই অর্ডার নিই। জী মাছ রেফ্রিজারেটরে রাখা হয় এই কারনে যে আমার মাছটা আমি সরাসরি অর্ডারের ভিত্তিতে বিল থেকে ধরি এবং তা রেডি টু কুক প্রসেসে সম্পূর্ণ কাটা ধোয়া পরিষ্কার করা অবস্থায় ঢাকায় এবং অন্যান্য জেলায় পৌঁছে দিয়ে থাকি। রেফ্রিজারেটর সিস্টেম করা হয়েছে এ কারণেই।

বিলের মাছ

আপনার কাছে এক সাথে অনেক অর্ডার আসলে কিভাবে ক্রেতার চাহিদা পূরণ করেন? মাছ কি রেফ্রিজারেটর এ সংরক্ষণ করা থাকে?

একসঙ্গে এখন আমার এক মনের মত মাছের অর্ডার আসে। মাত্র দুই মাসের মধ্যেই আমার এখন চার থেকে পাঁচ জন জেলে আছে নিজস্ব মাছ কাটা এবং ধোয়ার জন্য আছে সাত জন মেয়ে।যারা সব সময় রেডি থাকে অর্ডার ওয়াইজ আমি জেলেদেরকে বলে দিলে তারা মাছ নিয়ে চলে আসে আমি পছন্দ করে নিই। আর আছে একজন কেয়ারটেকার যে সব মাছ মেয়েদেরকে দিয়ে কাটা ধোয়া ফ্রিজাপ করার দায়িত্ব পালন করে। প্রথম দিকে আমার বোন এবং বোনের ছেলে আমার ছেলে সহযোগিতা করত ‌। কিন্তু এখন প্রতিদিন অর্ডার আসতে ওদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না বিধায় আমাকে একজন কেয়ারটেকার নিযুক্ত করতে হয়েছে কাজগুলোকে তদারকি করার জন্য।আমি মাছ ধরে রেফ্রিজারেটরে মজুদ করে রাখি না। অর্ডার অনুযায়ী বিলের মাছ বিলের পাশ থেকেই কিনে নেই। এরপর ক্রেতার কাছে পৌঁছানোর পূর্বে আমি মাছ রেফ্রিজারেটরে রাখি এই কারনে যে আমার মাছটা আমি সরাসরি অর্ডারের ভিত্তিতে বিল থেকে ধরি এবং তা রেডি টু কুক প্রসেসে সম্পূর্ণ কাটা ধোয়া পরিষ্কার করা অবস্থায় ঢাকায় এবং অন্যান্য জেলায় পৌঁছে দিয়ে থাকি। রেফ্রিজারেটর সিস্টেম করা হয়েছে এ কারণেই।

মেজো ছেলের সাথে শিউলি ইসলাম তালুকদার

আপনি ঢাকার বাসিন্দা, তারপরেও প্রতি সপ্তাহে নাটোরে যেয়ে নিজে তদারকি করার জন্য যেতে হয়। এই যাতায়াত এর ব্যাপারটি কি মাছের মূল্যের উপরে কোন প্রভাব ফেলে?

হ্যাঁ প্রতি সপ্তাহের যাওয়া-আসা ব্যাপারটা কতটা প্রভাব না ফেলে ও এখন আমার যাওয়ার ব্যাপারটা প্রভাব ফেলছে এ কারণেই যে আমাকে সপ্তাহে দুইবার এমনকি ৩ বার ও যেতে হচ্ছে। তবে আমার কাছে লাভ করাটা মুখ্য বিষয় না।খুব বেশি লাভ না হলেও আমি প্রথমে চেয়েছি আমার ইশিনা গ্রোসারির সেবা ও পণ্য সবার কাছে পৌঁছে দিতে। এক রকম দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা ও আমার কাছে কাজ করেছে। যান্ত্রিক জীবনে আমরা ফরমালিন মুক্ত খাবার টা এখন হাতের কাছে বেশি পাই।এখন অধিকাংশ মেয়েরাই কর্মজীবী হওয়ায় চাইলে ছোট মাছ কাটা ধোয়া বাজার থেকে এনে প্রসেসিং করে খাওয়াটা সম্ভব হয়ে ওঠে না এ কারণে প্রায় ছোট মাছ খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে অনেকের পরিবারে। আমি চেয়েছি যাদের মন চায় তাদের প্রত্যেকের ঘরে আমার নাটোরের ঐতিহ্যবাহী চলন বিলের মাছ পৌঁছে দিতে। আর এ কারণেই লাভ লস তাকে আমি খুব বেশি মুখ্য ভাবে দেখিনা। আমি চেয়েছি আমার বেশি না গ্রোসারি একটা বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপ নিক। লাভ সেখানে  কম হোক তবে প্রত্যেকের মুখে মুখে থাকুক ইসিনা গ্রোসারির বিলের মাছ এবং ভেজালমুক্ত খাদ্য দ্রব্য পণ্য গুলো।

কি কি মাছ আপনি ক্রেতার নিকট পৌঁছে দিয়ে থাকেন?

আমার ইশিনা গ্রোসারীতে পাওয়া যায় দেশি বিলুপ্তপ্রায় ছোট বড় সব রকমের মাছ । এদের মধ্যে টেংরা, গুচি মাছ, বাটা মাছ, রিঠা মাছ, পুঁটি মাছ, রাজপুটি, পাবদা, মলা, মাগুর, খলসে, দেশি কই, খয়রা, কাজল বা বাঁশপাতা, বউ মাছ বা রানী মাছ, কাচকি, বিল টেংরা বড় এবং ছোট, দেশি শিং, তিন কাটা বা দাড়কিনা, চেলা মাছ, চাপিলা মাছ, ভাঙ্গন মাছ, রাইখোর মাছ, পাতাসি, টাকি মাছ, বাটা মাছ, নাইলোটিকা মাছ, দেশি মাঝারি বড় রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস, শোল, বোয়াল, আইড়, বাইন মাছ, চিতল মাছ, সিলভার কাপ, তেলাপিয়া, গ্রাস কার্প, বেলে মাছ ইত্যাদি।

আপনার মাছ বিক্রির জন্য কোন স্পেশাল সার্ভিস কি আছে যা ক্রেতাদের আকর্ষণ করে।

স্পেশাল সার্ভিস এর কথা আমি আগেই বলেছি যেটা রেডি টুকু সার্ভিস। অবশ্যই বিলের মাছের চাহিদা সারাদেশে ব্যাপক আর তা যদি হয় হালতির বিল চলনবিল তাহলে তো কোন কথাই নেই এছাড়াও শুধুমাত্র কাটা ধোয়া এবং পরিষ্কার করার জন্য ও অনেক ক্রেতা আমার কাছে মাছ নেয়। আমি টাটকা এবং অরিজিনাল বিল ও আত্রাই নদীর মাছ সরবরাহ করছে নিজে তদারকির মাধ্যমে আর এটাই হচ্ছে আমার গ্রোসারির এত চাহিদার মূল কারণ।

টাটকা ফরমালিন মুক্ত সব্জি

আপনার মাছের অনলাইন বিজনেস সহ অন্যান্য পণ্যের বিজনেস এর সফলতা আমাদের সাথে শেয়ার করুন।

গ্রোসারির ছাড়া আমার আছে সীমান্ত সম্ভার শপিং কমপ্লেক্স এ একটা পোশাকের শোরুম, আছে অনলাইনে দেশি পোশাক বিক্রি পেজ অহংকার এর তাঁত আর আছে অনলাইনে ঘরোয়া খাবার ডেলিভারি পেজ শাশুড়ির হেঁশেল। আমার অহংকারের তাঁতে রয়েছে টাঙ্গাইলের পাবনার শাহজাদপুর সিরাজগঞ্জ এসব এলাকার তাঁতের শাড়ি থ্রি পিস।

বাটিক থ্রী পিস

টাঙ্গাইলের হাফসিল্ক ফুল সেক মসলিন সিল্ক মসলিন জামদানি হাফ সিল্ক জামদানি সুতি জামদানি চেক সব রকমের শাড়ি এবং থ্রি পিস রয়েছে। আরো রয়েছে কাতান বেনারসি জামদানি শাড়ি পাঞ্জাবি থ্রি পিস। এবং আমি খেশ শাড়ি নিয়ে ট্রেডিশনাল ফিউশনে কাস্টমাইজ করার জন্য ইতিমধ্যে লেখাপড়া শুরু করেছি এবং যোগাযোগ করছি। ইনশাআল্লাহ শিগগিরই খেস শাড়ির নতুনত্ব কিছু নিয়ে হাজির হব আমার কাস্টমারের সামনে। এছাড়াও শীতে কাশ্মীরি ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তানের সাল রয়েছে আমার ইশিনা অফলাইন শপে। ইশিনা শপে রয়েছে নানান রকমের গর্জিয়াস ও পার্টি ওয়্যার। প্রত্যেকটা সেক্টরে আল্লাহর রহমতে বেশ ভালো সাড়া পেয়েছি। দুই মাসে আমার টোটাল সেল এসেছে দুই লক্ষের অধিক। 2 লক্ষ 15 হাজার আজকের দিন পর্যন্ত আমার সেল।

নানা রকম ফ্রায়েড রাইস এবং বিরিয়ানি

আমার শাশুড়ির হেঁশেল এ ও এর মধ্যে প্রায় 30 টার বেশি ঘরোয়া খাবারের অর্ডার কমপ্লিট করেছি তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল বিরিয়ানি। আমার সিগনেচার আইটেম হলো সব রকমের বিরিয়ানি ফ্রাইড রাইস, চিকেন ফ্রাই, চাইনিজ ভেজিটেবল, চুই ঝালের সব রকমের মাংস। তবে ঘরোয়া দেশি যেকোনো রান্না আমার শাশুড়ির হেঁসেল থেকে অর্ডার নেওয়া হয়। বিশেষ করে সব রকমের ছোট মাছের চচ্চড়ি শিম দিয়ে এবং সব রকমের তরকারি দিয়ে বিলের বড় মাছের ছোট মাছের যেকোনো চচ্চড়ি, বিলের যে কোন মাছের ভুনা, এবং নানা রকমের ভর্তার সাথে চলনবিলের শুটকি থেকে শুরু করে চিটাগাং এর শুটকির সব রকমের আইটেম এর অর্ডার নিয়ে থাকি।দুই থেকে আড়াই মাসের ভিতরে আমার অনলাইন উদ্যোক্তা জীবনের সফলতা আমার এত এত কাস্টমারের ভালোবাসা আর অফুরন্ত দোয়া।

আপনার উদ্যোক্তা হবার পথে কোন বাধার সন্মুখিন আপনাকে হতে হয়েছিলো? কিভাবে তা মোকাবেলা করেছেন?

তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাওয়ায় লেখাপড়া কমপ্লিট করতে আমাকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি বিএসএস নিয়ে। মাস্টার্স করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক ছিলাম এবং আমার হাজব্যান্ড ছিলেন এমপিওভুক্ত কলেজের প্রিন্সিপাল। অত্যন্ত মেধাবী তিন ছেলের মা আমি।বাচ্চাদের মানুষ করার পাশাপাশি প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করতাম। কিন্তু আমরা অধিকাংশ মেয়েরা সবসময় শ্বশুরবাড়িতে বিভিন্ন কারণে নির্যাতিত হ‌ই। আর এই নির্যাতনের প্রতিবাদ স্বরূপ আমি আমার লেখাপড়া চালিয়ে গিয়েছি এবং এখনও মাস্টার্স পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিছু সমস্যার সম্মুখীন হওয়ায় আমি চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা শুরু করি। ২০০৯ সালে ব্র্যাক এনজিও থেকে মাত্র ২০,০০০ হাজার টাকা লোন নিয়ে বাড়িতেই শুরু করি আমার ব্যবসা। ঢাকা থেকে দেশি ব্লকের শাড়ি টাঙ্গাইলের শাড়ি এবং আমাদের দেশী নাম্বার ওয়ান ব্র্যান্ড ড্রেস লাইনের ড্রেস দিয়ে। প্রথমবারে আমার সেল এত বেশি হয় যে আমাকে এক সপ্তাহের ভিতরে আবার মাল নেওয়ার জন্য ঢাকা আসতে হয় এবং দ্বিতীয়বার সেল করার পরে আমি ব্র্যাকে টাকাটা শোধ করে দিই ও নতুন করে আবার আগের চেয়ে দ্বিগুন পরিমান মাল তুলতে পারি। এরপরে এত বেশি কাস্টমার ভ্যালু বাড়তে থাকে যে বাসায় যত্রতত্র মানুষ আসতে শুরু করে যেটা আমার শাশুড়ি সাপোর্ট করেনা।এই কারণে আমাকে বাধ্য হতে হয় দোকান নেওয়ার জন্য। কিন্তু পরিবার থেকে সেখানেও কোন সাপোর্ট দেয় না।কারন আমার দোকান ছিল তখন নাটোরে মহিলাদের ভিতরে প্রথম ঘরের বাহিরে ভাড়া নেওয়া দোকান। দুই একজন মহিলা অবশ্য ব্যাবসা করছিল কিন্তু তারা নিজের বাড়িতে। তবে আমি ছিলাম প্রচন্ড জেদী শ্বশুরবাড়িতে থেকে সবাই বাধা দিলেও আমি দোকান নেই। এই কারণে আমাকে প্রতিনিয়ত মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হতো সেটা কি শাশুড়ি কি কাজের মেয়ে কি হাজবেন্ড! বেশ ভালো চলছিল আমাদের সংসার। কিন্তু শশুর বাড়ি থেকে ব্যবসা করা পছন্দ না করায় এবং কারো কোনো রকমের সহযোগিতা না পাওয়ায় একসময় তা বন্ধ করে দিতে হয়। কিন্তু কাল হয় হাসবেন্ড মারা যাওয়ার পর। হঠাৎ করে আমার হাসবেন্ড মারা যায় হার্ট অ্যাটাক করে। তখন বাচ্চারা সবাই ছোট। বড় ছেলেটা মাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে, মেজ ছেলেটা ক্লাস নাইনে, আর ছোট ছেলেটা ক্লাস ফাইভে। আমি দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে দিশেহারা হয়ে পরি। কারণ আমরা বাচ্চাদের অনেক ভালো ভালো স্কুল-কলেজে পড়ার জন্য কোন ব্যাংক ব্যালেন্স জমাতে পারিনি। আমাদের লক্ষ্য ছিল শুধু সন্তান গুলোকে খুব ভালোভাবে এবং খুব ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়িয়ে মানুষ করা। আর ফ্যামিলি থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা না পাওয়ায় আমার পুরোপুরি পাগল হওয়ার মত অবস্থা হয়। শশুর বাড়ির কেউ চাই নি আমি বাচ্চাদের এতো ভালো ভালো স্কুল কলেজে পড়ায় ঢাকায় থেকে। সবাই চেয়েছে আমি বাড়ি ফিরে যাই এবং বাচ্চাদের সরকারি স্কুল কলেজে ভর্তি করে দিয়ে ছাপোষা জীবন চালাই।

তিন ছেলের সাথে শিউলি ইসলাম তালুকদার

কিন্তু আমি ছিলাম প্রচন্ড জেদী আর আমার লক্ষ্যে অটুট। আমি শুরু করলাম অনলাইনে বিজনেস।পেজ আমার আগে থেকেই খোলা ছিল কিন্তু সেখানে মেম্বার এড করা কিংবা পেজ প্রমোট করা বুস্ট করার কিছুই ছিল না। শুরু করলাম অনলাইনে নতুন করে যাত্রা। আর বাচ্চাদেরকে বললাম তোমরা শুধু তোমাদের লেখাপড়া করতে থাকো আমি যে ভাবে পারি তোমাদের লেখাপড়া শেষ করাবোই ইনশাআল্লাহ। এরমধ্যে আমি আমার সরকারি চাকরিটা ছেড়ে দেই শুধুমাত্র নিজের ছেলেকে ক্যাডেট কলেজে লেখাপড়া কন্টিনিউ করার জন্য। কারণ ওর তখন এসএসসি কমপ্লিট করার জন্যই লাগতো প্রায় সাত লাখ টাকা। আর আমার হাজবেন্ডের গ্র্যাচুয়িটির টাকা পেতে সময় লাগে আড়াই বছর। এই আইটা বছর ছিল আমার জন্য আর আমার বাচ্চাদের জন্য এই পৃথিবীর জাহান্নামের পরীক্ষা।

 

বাচ্চাগুলো চোখ মুখ বন্ধ করে শুধু লেখাপড়া করেছে এমন অনেক দিন গেছে জামার বাচ্চাদের মুখে খাবার উঠেনি একবেলার বেশি। আমাদের হাসি মুখ দেখে কেউ সেটা বোঝেওনি।এরমধ্যে আমার হলো একটা বড় শারীরিক সমস্যা তার জন্য অপারেশন করতে হলো সেখানেও প্রায় দুই লাখের মতো টাকা চলে গেল।যা টাকা ছিল এই দুই আড়াই বছরের ভেতরে শেষ। অনেক কষ্ট করে চলার পরে আমার হাজবেন্ডের গ্রাচুয়িটির টাকাটা পেলাম।সেখান থেকে ধার দেনা যা কিছু হয়েছিল শোধ করার পরে ধানমন্ডি রাইফেল স্কয়ার এর সীমান্ত সম্ভার শপিং কমপ্লেক্সে একটা দোকান নেই কিন্তু বিধিবাম এখানে আমার ভাগ্য আমার সঙ্গে বিট্রে করে।দোকান এর ওপেনিং এর মাত্র ৫ দিন পর এই লকডাউন শুরু হয়। আমি চোখে সর্ষে ফুল দেখা শুরু করি।আমার যা টাকা পয়সা ছিল সব দিয়ে আমি দোকান চালু করেছিলাম। পাগলের মত দিনরাত কান্নাকাটি করতে থাকি নামাজ পড়ে। বাচ্চারা ও মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পরে।এর মধ্যে হঠাৎ করে এক ছোট বোনের মাধ্যমে ওমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম উইতে এড হই। ওখান থেকে আমি পেয়ে যাই এক ভিন্নধর্মী আইডিয়া। এভাবেই আমাকে পারিবারিক ভাবে, ভাগ্যের কাছে বারবার বাধা প্রাপ্ত হতে হয়েছে। কিন্তু আমি থেমে থাকিনি, যখন যা করবো বলে ঠিক করেছিলাম তাই করে দেখিয়েছি শত প্রতিকূলতার মাঝেও। আল্লাহ আমাকে সব ক্ষেত্রেই সফলতা দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ্‌।

যারা নতুন উদ্যোক্তা হতে চায় তাদের পথ নির্দেশনায় কিছু বলুন।

যারা নতুন উদ্যোক্তা হতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে আমি একটা কথা বলবো আপনারা যেটা করুন না কেন সেটা নিয়ে খুব ভালোভাবে পড়াশোনা করে জেনে বুঝে তারপরে শুরু করুন। কারণ জেনে বুঝে শুরু না করলে নানা রকমের ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হতে হয় আমি যার সাক্ষী। আর অবশ্যই ভীষণ রকমের পরিশ্রমী, এবং প্রচন্ড রকমের ধৈর্যশীল হতে হবে উদ্যোক্তা হতে হলে। আর একটা বিষয় মনে রাখতে হবে সততা হচ্ছে ব্যবসায় উন্নয়নের মূল ভিত্তি। আপনার লাভ কম হোক কিন্তু আপনার কাস্টমারকে কখনোই আপনি ঠকানোর চিন্তা করবেন না। আজকাল ই-কমার্স এর ফলে প্রত্যেক মেয়েই চাইলেই উদ্যোক্তা জীবন শুরু করতে পারে। যেকোনো মেয়েকে যেকোনো সময় যেকোনো বিপদের মোকাবেলা করতে হতে পারে ঠিক আমার মত। মাঝ জীবনে হাসবেন্ড মারা যাওয়ার পরে আমাকে যে ভয়ানক দুর্বিষহ সময় পার করতে হয়েছে এমন আর কাউকে না করতে হোক। আর এই কারনেই আমার পরামর্শ থাকবে প্রত্যেককেই কি ছেলে কি মেয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য নিজ যোগ্যতায় চেষ্টা করতে হবে স্বপ্ন দেখতে হবে। স্বপ্ন আর চেষ্টা মানুষকে এই দুইয়ের সংমিশ্রণে পারে একটা মানুষকে উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করাতে। আর সবচেয়ে বড় কথা নিজের রোজগার নিজের কষ্টের অর্থ উপার্জন এর থেকে পৃথিবীর বড় শান্তির জায়গা আর নেই। আজ আমি আমার সন্তানদেরকে আগের মতো করেই পড়ালেখা করাতে পারছি। সংসার খরচ মান্থলি প্রায় এক লক্ষ টাকার মতো। আমি এসব কিছু সংস্থান করতে পারছি আমার ইশিনা গ্রুপ থেকে। গ্রুপ বলছি এ কারণেই আমার অফলাইন শপ অনলাইন শপ পোশাকের এবং আমার গ্রোসারি সবকিছুরই নাম ইশিনা। 

আপু আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের সময় দেয়ার জন্য। আপনি সত্যিই আমাদের দেশের উদ্যোক্তাদের জন্য একজন আদর্শের মতো কাজ করে দেখিয়েছেন। আশা করছি নতুন উদ্যোক্তারা বা যারা উদ্যোক্তা হতে চায় আপনার জীবন থেকে, আপনার কাজ থেকে অনেক অনুপ্রেরণা পাবে, নিজেদের মনবল দৃঢ় করতে পারবে। আপনার জন্য রইলো অশেষ শুভকামনা। প্রিয় পাঠক আপনারা নিশ্চয় এতক্ষনে বুঝে গেছেন মেয়েদের সাধ্যে নেই এমন কোন কাজ নেই। আর নাটোরের বিলের তাজা মাছ খেতে ক্লিক করুন “ইশিনা গ্রোসারীতে”।


Leave a Reply

Your email address will not be published.