টাঙ্গাইলের বিলুপ্ত প্রায় খেশ সংরক্ষণে স্মৃতির বৃত্ত


মসলিন, জামদানী আর খাদি এর মতো খেশ একটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্প। অনেকেই খেশের নাম জানেনা। কেমন কাপড় তাও জানেনা। বিংশ শতাব্দির শুরুতে কিন্তু এই কাপড়ের চাহিদা ছিলো বেশ। রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতন এর বিশ্বভারতী বিশ্ব্যবিদ্যালয়ে হাতেখড়ি হয় বর্তমান খেশ তাঁতিদের পুর্ব পুরুষদের! শিল্পির মনন শৈলিতে তাঁতিরা খেশের উপরে সুন্দর নকশা বুনে, যেন স্বপ্নলোকের ছোঁয়া। কিভাবে তৈরী হয় এই খেশ? আর কোথায় তৈরী হয়? কি এমন বৈশিষ্ট্য তার যে খেশ কিনে পরতে হবে? এক এক করে জানিয়ে দিচ্ছি আপনার মনের সকল অজানা প্রশ্ন। টাঙ্গাইলের খেশ তাঁতিরা পুরোনো কাপড় দিয়ে খেশ বুনে থাকে। পুরনো কাপড়ই খেশের অন্যতম উপকরন। পুরনো কাপড় ব্যবহার হয় বলেই এর নমনীয়তা অসাধারন আর পরতেও বেশ আরামদায়ক। তাঁতিরা একদিনে ২টি শাড়ি বুনতে পারে। খেশ কাপড় দিয়ে শাড়ি, পাঞ্জাবি, ব্যাগ এবং চাদর তৈরি করা যায়। কালের আবর্তনে খেশের ঐতিহ্য প্রায় ম্রিয়মান হয়ে পরে। কিন্তু অনেক তরুন উদ্যোক্তা খেশ এর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমাদের বাংলাদেশের জামদানী, খাদি আর মনিপুরী তাঁত শিল্পের সাথে সমান তালে পুর্বের বমত জনপ্রিয় করে তুলতে চান তারা খেশ কে। তেমন একজন তরুন উদ্যোক্তা অনার্স ফাইনাল ইয়ারে ছাত্রীফারজানা হায়দার স্মৃতি। বাবা সরকারি চাকুরী জিবি মা গৃহিণী। দুই বোনের মাঝে তিনি ছোট। পড়ালেখার পাশাপাশি তার সখের অনলাইন বিজনেস এর জন্য একটি ফেইসবুক পেইজ খুলেন, নাম দেন বৃত্ত।  সাথে একটি বাই অ্যান্ড সেল গ্রুপ ও আছে তার বৃত্ত নামে। এখানেই তিনি তার অন্যান্য ব্লকের শাড়ি, কাপল শাড়ি-পাঞ্জাবি সেট এর পাশাপাশি কাজ শুরু করেন টাঙ্গাইলের খেশ নিয়ে। অন্যান্য পন্য দেশের বাহিরে প্রবাসীদের কাছে পৌঁছে দিতে পারলেও তার স্বপ্ন খেশ পৌঁছে দিতে চান বিদেশের দোর গোড়ায়। স্বপ্ন দেখেন খেশের ঐতিহ্য কে তুলে ধরতে সবার সামনে। আমরা আজ তার সাথে কথা বলবো, তার কাছে জানবো তার পথ চলা এবং স্বপ্ন ও সফলতার গল্প। আশা করছি নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য আশার আলো দেখাবে এই আলোচনা।

আপনার কাজের শুরুর গল্পটা বলুন, কবে থেকে আপনি অনলাইন বিজনেস করছেন।

কাজ শুরু করেছি গতবছরের আগস্ট থেকে। লকডাউনে বসে বসে ভাবছিলাম নিজে কিছু করতে হবে। এভাবে আর কতদিন থাকবো। এই ভাবনা থেকেই কাজ শুরু করি। কাজের মূল লক্ষ্য ছিল দেশীয় পণ্যকে সব জায়গায় তুলে ধরা।

খেশ আপনি কোথায় থেকে সংগ্রহ করেন?

খেশ সম্পর্কে আগে আমি নিজেও ঠিক মতো জানতাম না। অনলাইনে অনেক কেই খেশ নিয়ে কাজ করতে দেখতাম। আমি কোন পন্য নিজে যাচাই না করে সেল করি না। তাই আমি সরাসরি তাঁতিদের সাথে যোগাযোগ করি। খেশ সম্পর্কে জানতে চাই। এক সময় আমার নিজের কাছেই অনেক প্রিয় হয়ে ওঠে খেশের শাড়ি, যেমন নরম, তেমনি আরাম দায়ক। তাঁতিদের কাছেই জানতে পারি এর ঐতিহ্য সম্পর্কে। কিভাবে প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে এই শিল্প তাও জানতে পারলাম। ভাবলাম এই জিনিস তো বিলুপ্ত হতে দেওয়া যায় না, আগেই বলেছি লকডাউনে ঘরে বসে না থেকে কিছু করার জন্যই অনলাইন বিজনেস শুরু করেছিলাম। আমার ফেইসবুক গ্রুপ ‘বৃত্ত’ তে সংযোজন করি খেশের শাড়ি। আমি এখনও সরাসরি তাঁতিদের থেকেই খেশ সংরহ করে থকি।

কাজের ক্ষেত্রে কোন বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো?কিভাবে সেই বাধা অতিক্রম করেছেন?

কাজ শুরু করার প্রথমে অনেক বাঁধার সম্মুখীন হয়েছি। প্রথম দিকে পরিবার থেকে তেমন সাপোর্ট পেতাম বা। আত্নীয়রা ভালোভাবে দেখতো না আমার এই কাজকে। প্রত্যেক উদ্যোক্তাকেই সোর্সিং আর পণ্যগুলো নিয়ে সময় দিতে হয়। আর এজন্যই তারা বাঁধা দিতেন। তবে পরবর্তীতে এই বাঁধা অতিক্রম করে ফেলেছি আলহামদুলিল্লাহ এবং তারা সবাই খুশি আমার এই উদ্যোক্তা জীবন নিয়ে।

একসাথে অনেক অর্ডার আসলে নিজস্ব কাজের পাশাপাশি কিভাবে ম্যানেজ করেন?

অনেক অর্ডার আসলে আমি সময় ভাগ করে কাজ করি। নিজস্ব কাজকে যেমন প্রাধান্য দেই ঠিক পাশাপাশি আমি আমার প্রফেশনকেও প্রাধান্য দিয়ে থাকি। আমি আমার কোন ক্রেতাকে নিরাশ করতে চাই না। 

খেশ নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানতে চাই।

খেশ নিয়ে আমার পরিকল্পনা হচ্ছে আমি চাই দেশের মানুষের পাশাপাশি বিদেশেও আমি এই শাড়ির পাঠাবো। দেশীয় শাড়ির গুরুত্ব সব জায়গায় উপস্থাপন করতে চাই। বাঙ্গালী নারীদের যেমন একটি জামদানী না হলেই নয়, একটি বেনারশি কাতান না হলেই নয়, ঠিক তেমনি যেন সবার সংরহে একটি করে হলেও খেশ থাকে। এটাই আমার স্বপ্ন আর সেলক্ষ্যেই আমার সকল প্রচেষ্টা। আমি এবার পহেলা ফাল্গুন কে সামনে রেখে খেশের শাড়ী আর খাদির পাঞ্জাবির কম্বিনেশনে কাপল সেট আমার বৃত্তে সংযোজন করেছি।  

বিদেশী বা প্রবাসীদের কাছে আপনার পণ্যের চাহিদা আছে কি?

খেশ শাড়ির পাশাপাশি আমি কাজ করছি ব্লকের শাড়ি,কাপল সেট নিয়ে। এবং সাথে কাজ করছি কুমিল্লার খাদি পাঞ্জাবী নিয়েও। এরমধ্যে আমি ব্লকের কাপল সেট দেশের বাইরে প্রবাসীদের কাছে পাঠিয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ তারা অনেক পছন্দ করেছেন আমার কাজকে। সামনে দেশীয় পণ্যের আরো কিছু জিনিস যুক্ত করবো আশা করছি।

যারা আপনার মতো নিজস্ব উদ্যোগে কিছু করতে চায় তাদের জন্যে কিছু পরামর্শ দিন ।

যারা চিন্তা করছেন উদ্যোক্তা হবেন তাদের জন্য প্রথম কথা হচ্ছে নিজ পণ্যকে ভালোবাসুন,পণ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ জেনে কাজ শুরু করুন। হুটহাট মানুষকে দেখে কাজে নেমে যাবেন না। মানুষের বিশ্বাস অর্জন করুন। দেখবেন সফলতা আপনার দুয়ারে এসে গেছে। সবার জন্য রইলো শুভকামনা এবং অফুরন্ত ভালোবাসা। যে যেভাবে সাপোর্ট দিয়েছেন আশা করি আগামীতেও আপনাদের সহোযোগিতা পাবো ইনশাআল্লাহ।

আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ, আপনি তরুন সমাজের একজন প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন, আপনার কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।  আপনার জন্য অসংখ্য শুভ কামনা রইলো যেন আপনি কুমিল্লার খাদির পাশাপাশি টাঙ্গাইলের খেশ কে নিয়ে যেতে পারেন এক অন্য মাত্রায়।


Leave a Reply

Your email address will not be published.