ঘরে তৈরী সুস্বাদু খাবার সরবরাহ করে নিজের স্বপ্ন পূরণে প্রত্যাশী কুসুম সজীব


বরিশালের মেয়ে কুসুম সজীব, ঘরে তৈরী সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর খাবার সরবরাহ করে নিজের স্বপ্নের  ক্যারিয়ার গড়েছেন তিনি। নরসিংদীর বউ তিনি কিন্তু  বর্তমানে আছেন রাজধানী ঢাকা শহরে। এই সুযোগেই সারা দেশে নিজের হাতে তৈরী মজাদার খাবার সরবরাহ করছেন নির্বিঘ্নে। মেট্রিক পরীক্ষার পর বিয়ে হওয়ায় পড়ালেখাটা আর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু স্বপ্ন পূরনে থেমে নেই তিনি। স্বামীর প্রেরণা আর নিজের অধ্যাবসায়ে আজ তিনি নিজের ব্যবসাকে উন্নিত করেছেন এই পর্যায়ে। কিন্তু তার স্বপ্ন আরোও সুদূর প্রসারী। তিনি যেতে চান আরও বহুদূর। খাবারের পাশাপাশি তিনি সূতি, লন আর লিলেনের থ্রী পিস নিয়েও কাজ করছেন। আজ আমরা তার সাথে কথা বলে জানবো তার এই পথ চলার অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে। আশা করি যারা ঘরে তৈরী খাবার নিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার কথা ভাবছেন তাদের জন্য সংলাপটি তথ্যবহুল হবে।

কুসুম সজীব এবং তাঁর একমাত্র ছেলে

কবে থেকে আপনি অনলাইনে ঘরে তৈরী খাবার নিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করলেন? কেনো মনে হল যে খাবার নিয়েই আপনাকে কাজ করতে হবে?

ঘরে তৈরী খাবার নিয়ে কাজ করার  কারন খাবারটা সবাই তৈরি করতে পারেন না। বর্তমানে সবাই কর্ম ব্যাস্ততায় দিন কাটায় সারাদিন কর্ম ব্যাস্ততায় কাটায় তারা দিন শেষে  অনেকেই রান্না করতে চায়না। বা সময়ের সাথে তাল মেলাতে পারেনা। আবার অনেকে রান্না ও ঠিক ভাবে জানেনা। আবার কারও বাসায় বয়স্ক আপনজন ও ছোট বাচ্চা রয়েছে। অনেক সময় তাদের পচ্ছন্দ মতো বা তাদের চাহিদা বা সময় মতো স্বাস্থ্যকর খাবার দিতে পারছেনা তাই তাদের সময়কে মুল্য দিতে এবং কাছের মানুষের কথা চিন্তা করে  আমার খাবার নিয়ে কাজ করা। আজকাল পত্রিকা খুললেই দেখা যায় রেস্টুরেন্টের ময়লা রান্না ঘর, অস্বাস্থ্যকর খাবারের কারনে লাখ লাখ টাকা জরিমানা হচ্ছে।সময়ের অভাবে ঘরে খাবার রান্না করার পরিবর্তে বাহিরে হোটেল রেস্টুরেন্টে খাবার খেয়ে  প্রতিদিনই গ্রাহকরা নিজের স্বাস্থ্যের হানী করছেন আর বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই সবকিছু চিন্তা করে আমি খাবার নিয়ে কাজ শুরু করি যেন সকলকে স্বাস্থ্যকর খাবার পৌঁছে দিতে পারি। তাছাড়া রান্নাটা আমার কাছে খুবই ভালোবাসার একটা ব্যপার।আর বিশেষ করে খাবার নিয়ে কাজ করার কারন হচ্ছে  আমরা সব সময় সুস্থ থাকতে চায়, সবাই যেন হাজার ব্যাস্তার মাঝেও ঘরের খাবার খেয়ে সুস্থ্য সুন্দর থাকতে পারে।

রান্না টা আমার শখ ছিলো তাই মাঝে মাঝে ইউটিউবে রান্না শিখতাম আর ম্যাগাজিন পেপার থেকে রেসিপি কাটিং করতাম। বাসায় সেগুলো প্রাকটিস করতাম।বাসার সবাই সেগুলো খেয়ে খুব প্রসংসা করতো। এতে রান্নার প্রতি আমার উৎসাহ বেড়ে গেলো আরোও কয়েক গুন। আমি বিভিন্ন রান্নার গ্রূপের যুক্ত হলাম। সেখানে অনেকেই অনলাইনে খাবার বিক্রি করতো। তখনতো আর বুঝতাম না যে অনলাইন বিজনেস কিভাবে করে। তাই কৌতুহল বশতঃ এক পরিচিত আপুকে জিজ্ঞেস করলাম। সে খুব গুছিয়ে সব কিছু বুঝিয়ে বলল। তখন অবশ্য ব্যাবসার কোনো ইচ্ছা ছিলোনা।কিন্তু রান্নার প্রতি ভালোবাসা থেকে বিভিন রান্না প্রতিযোগিতা, মাঝে মাঝে বিভিন্ন পিঠা মেলা আর কুইজে অংশ নিতাম। এরপর ২০২০ সালে নারী উদ্যক্তা গ্রূপ অপরাজিতাতে যুক্ত হলাম। সেখানে সকলের উদ্যক্তা হবার গল্প পড়ে পড়ে নিজের মাঝে অন্য রকম কিছু কাজ করলো।আমিও তো পারি ঘরে বসে কাজ করতে। যেহেতু রান্নাটা আমার বেশ ভালো রকমের আয়ত্তে আছে তাই স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম রান্না নিয়েই কিছু করবো। যেই ভাবা সেই কাজ। তারপরে মার্চ মাসেই আমার প্রথম পেইজ “গৃহ কোন” খোলা।সেখান থেকেই অনলাইন বিজনেসে আমার যাত্রা শুরু।

ফ্রোজেন ফুড আইটেম

আপনার খাবারের গুনগত মান সম্পর্কে কিছু বলুন।

আলহামদুলিল্লাহ প্রথম সাত মাসে প্রায় ২৫০ জন ক্রেতা আমার খাবার নিয়েছেন।তাদের মধ্যে ত্রিশ জন আমার রিপিট কাস্টোমার।আর ঢাকার বাহিরে ৭ জেলাতে আমার তৈরি পিঠা, ঘিয়ে ভাজা লাচ্চা সেমাই আর বাকরখানি পৌছুতে পেরেছি। আলহামদুলিল্লাহ খাবারের স্বাদ ও মান সম্পর্কে আমার কাস্টমাররা নিজেরাই পজিটিভ রিভিউ দেন কখনও ফোন দিয়ে কখনও সোশ্যাল মিডিয়াতে পোষ্ট করে।এটা আমার অনেক বড় একটা সাফল্য। আর একটা জিনিস আমার অনেক বড় প্রাপ্তি যে আমার কাস্টমাররা সব সময় তাদের পরিচিতদের আমার খাবারের রিকমেন্ড করে। আমি সব কিছু নিজের হাতে তৈরি করি। হাতে গ্লভস পরি, মাথায় টুপি দেই যেন চুল খাবারে না পরে। খাবারের উপকরনের এক্সপায়ার ডেট দেখে বাছাই করি। বাজারের সবচেয়ে ভালো ব্রান্ডের পন্য যেমন আটা, ময়দা, তেল, ঘি ইত্যাদী ব্যবহার করি। খুব সাবধানে প্যাকিং করি এবং প্যাকিং করার সময় ও গ্লভস পরি। আমার রান্না ঘর সব সময় পরিপাটি আর টিপটপ থাকে। আমি প্রতিদিন সময় নিয়ে রান্না ঘর পরিস্কার করি। কাজেই আমার খাবারের গুঙ্গত মান নিয়ে কোন প্রশ্নই ওঠে না। আমি এ ব্যপারে খুবই সতর্ক থাকি। ক্রো বিশ্বাস ভংগ করার পক্ষপাতি আমি মোটেও নই।

ঐতিহ্যবাহী নকশী পিঠা

ব্যবসার ক্ষেত্রে কি কি বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়েছে আর তা কাটিয়ে উঠছেন কিভাবে।

ব্যাবসার ক্ষেত্রে আমরা নানা রকম বাধার সম্মুখীন হই সে যে ব্যাবসাই হোকনা কেন। আর আমিতো একজন অনলাইন বিক্রেতা তার ওপর একজন নারী। অনেকেই বলেছে অনলাইন ব্যাবসা এটা আবার কেমন কথা।সবাই যে তোমাকে টাকা দিবে তার গ্যারান্টি কি। তার ওপর খাবার কিভাবে পৌছাবা। তার ব্যবস্তা কি। আর তোমারতো ব্যাবসার দরকার নেই তোমার সংসারে কোন অভাব নেই, বর ব্যবসার সাথে চাকরি করে মাসে ভালো আয় করে। তাহলে তােমার কাজের দরকার কি। তুমিতো দিব্যি আছো। তার পরে এইসব কাজে তোমার তো কোনো লাভ নেই বরং অনেক খাটনি। না সংসার সামলাতে পারো না বাচ্চার খেয়াল রাখতে পারো। কি দরকার এসব করার মেয়েরাকি ব্যাবসা করতে পারে। আরও কতো কথা বলে। আমি বলবো আমরা নিজেরাই নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী হই একজন আর একজনের ভালো দেখতে পারিনা। তবে এটা ভেবে আমার কাছে ভালো লাগে যে আমার পুরো পরিবার আমাকে সাপোর্ট করে বিশেষ করে আমার স্বামি ,মা, শাশুরি আর খালারা। তাদের একই কথা তুমি তোমার মতো কাজ করো বাহিরের লোক হাজার কিছু বলবে তাই বলে তাদের কথায় কান দিতে নেই।

ফ্রোজেন স্ন্যাক্স

আপনার আয় (আনুমানিক) সম্পর্কে বলুন। 

আয়টা হচ্ছে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। যেহেতু আমি খাবার নিয়ে কাজ করি প্রতিদিন যে অর্ডার আসবে তা না। আর প্রতিমাসে যে আহামরি কিছু সেল হবে তা না। প্রথম প্রথম তো কোনো মাসে আমার ২০০০ টাকা আবার কখনও ৫০০০ টাকা আয় হতো। আবার কখনও কোনো খাবার বিক্রিই হতো না। আর এখন আলহামদুলিল্লাহ মাসে কম হলেও ১০ হাজার প্লাস টাকা আয় হয়। ভেবে ভালো লাগে যে আমি একজন নারী ঘরের বাহিরে না গিয়ে ঘরে থেকেই আমিও কিছু করতে পারছি।নিজের উপার্জন থেকে যা পাই তাই দিয়ে নিজের ছোট ছোট স্বপ্ন গুলো পুরোন করছি। স্বামির পাশে দাড়াতে পারছি পরিবারের পাশে দাড়াতে পারছি। ছেলের ছোট ছোট আবদার মেটাতে পারছি।আর আমার এই সফলতার জন্য আমার পরিবার খুবই খুশি। কিন্তু আমি আরও সামনে যেতে চাই, এই লক্ষ্যেই পরিশ্রম করে যাচ্ছি।

হালুয়া

সংসার এবং ব্যবসা কিভাবে একসাথে দুটোর ভারসাম্য রেখে কিভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন?

প্রথম যখন কাজ শুরু করি। তখন খুবই হিম শিম খেতে হতো। কারন সংসারের কাজ ছোট বাচ্চা তার পরে নিজের কাজ।মাঝে মাঝে আমার মতো হোম সেলার কয়েক জনের কাছে জানতে চাইতাম  তারা কিভাবে কি করে। তারা ডিটেলস বলতো। অনেকেই আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।  যা ভোলার নয়।এর পরে দিন দিন আমার অর্ডারের বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই মাঝে মাঝে কিছু কাজ রাত জেগে সাড়তাম।আবার মাঝে মাঝে বেশি কাজের চাপ পরলে মাকে নিয়ে আসতাম ছেলেকে রাখার জন্য। ধীরে ধীরে সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিতে শিখেছি।অর্ডারের যে কাজ গুলো আগে করে রাখা যায় সেই কাজ গুলো রাতে করে রাখি আর সবসময় ক্রেতার কাছে এক দিনের সময় বেশি নেই।এভাবেই সময় ম্যানেজ করে ব্যবসা আর সংসারের কাজ আর বাচ্চা সামলে ব্যাবসাটা চালিয়ে যেতে পারছি।

ভাত,ভর্তা এবং মাংস

আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই।

খাবার নিয়ে বহুদূর যাবার ইচ্ছে আছে। প্রতিটি জেলায় আমার খাবার পৌছানো র ইচ্ছে আছে। দেশের বাহিরে রপ্তানি করার ইচ্ছে আছে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আমার এমন যে বর্তমান সময় সকলের মুখে শুনতে হয় মেয়েদের কোনো বাড়ি নেই। মেয়েরা অন্যের উপর নির্ভর করে চলে। 

তাই আমি চাই আমার নিজের কিছু হোক আর আমার মায়ের জন্য আর পরিবারের জন্য কিছু করতে চাই। যেনো সবাই আমাকে নিয়ে গর্ব করতে পারে

 

যারা খাবার নিয়ে কাজ করতে চায় এবং আপনার মত সফল উদ্যোক্তা হতে চায় তাদের জন্যে কিছু টিপস দিন।

আপনারা অবশ্য খাবারের মানটা ধরে রাখবেন আর সময়ের মুল্য দিবেন। আর যারা নতুন কাজ করবেন তারা অবশ্যই যে খাবার সেল করবেন তা বাসায় বার বার ট্রাই করবেন আর পরিবারের সকলকে বা আত্মীয় স্বজনদেরকে বার বার টেস্ট করাবেন তারা যদি ভালো বলে তাহলেই সেল করবেন নয়তো খাবারের মান যদি ঠিক না থাকে তাহলে প্রথম কাস্টোমার আর রিপিট কাস্টোমার হবেনা। তাই খাবারের মান দাম ঠিক রাখলে ও সময়ের মুল্য দিতে পারলেই সফলতা সম্ভব।

 

আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আপু আমাদেরকে এতো সময় দিয়ে আপনার মুল্যবান অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য। আশা করছি আপনি এবং আপনার গল্প নতুনদের জন্য অনুপ্রেরনার কারন হবেন। আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সফল হোক আর আপনার ব্যবসার উত্তরোত্তর উন্নতি হোক এই শুভকামনা করছি।


Leave a Reply

Your email address will not be published.