ঐতিহ্যবাহী তাঁতের জামদানীর হাত ধরে সফলতার পথে তাসনিম


জামদানী শাড়ি বাংলাদেশের নারীদের ভালোবাসার অপর নাম, এ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। নিজের শাড়ির কালেকশনে একটি হলেও জামদানী নেই বা জামদানী রাখার ইচ্ছে নেই এমন মেয়ে বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া ভার! কিন্তু মেশিনে বোনা জামদানী তাঁতে বোনা জামদানীর স্থান দখল করে নিচ্ছে ক্রমশ। কম দামে পাবার আশায় অনেকেই না বুঝে ক্রয় করছেন নকল জামদানী। জামদানী কাপড়ের এই করুন দিনে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অনেকেই। তাদের মধ্যে তাসনিম বিনতে মাহাবুব একজন। যিনি সরাসরি তাঁত থেকে সংগ্রহ করে ৬০ থেকে ৮০ কাউন্টে সূতোয় বোনা জামদানী সরবরাহ করছেন। জামদানীর মান খাঁটি হওয়ায় ব্যবসা নিয়ে সঙ্কটে পড়তে হয়নি তাঁকে। আজ দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে প্রবাসীদের কাছে সমাদৃত হয়েছে তাঁর শাড়ি। তাসনিম বিনতে মাহবুবীর পড়াশোনা এম.বি.এ (আই.আই.ইউ.সি) এবং পিজিডি এইচ.আর.এম (বিআইএম)। দেড় বছর চাকরি করার পর ব্যক্তিগত সমস্যায় চাকরি ছেড়ে দিতে হয় তাঁকে কিন্তু ব্যবসায় প্রশাসন এর ছাত্রী হওয়ায় অনেক আগে থেকেই শখ ছিল নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার। আজ এই সফল উদ্যোক্তার নিজ হাতে গড়া তাঁর এই উদ্যোগের গল্প শুনবো তাঁর মুখ থেকেই। চলুন সরাসরি টাওনিম বিনতে মাহাবুবের সাথে আলাপচারিতায় যাওয়া যাক।

স্বামীর সাথে তাসনিম বিনতে মাহাবুবা

তাসনিম আপু আপনি  জামদানি নিয়ে কবে থেকে কাজ করছেন? ব্যবসার জন্যে জামদানি শাড়ি কেন বেছে নিলেন?

ব্যবসায় প্রশাসন এর ছাত্রী হওয়ায় অনেক আগে থেকেই শখ ছিল নিজেকে উদ্দোক্তা হিসেবে তৈরী কারার।এরই মাঝে জামদানী এবং জামদানীর তৈরি যেকোন পন্যই আমার খুব পছন্দের ছিল। একবার তাঁতিবাড়ী যাই জামদানী  কিনতে। সেখানে যাওয়ার পর তাঁতির হাতে বোনা আসল ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই জামদানী শাড়ী বানানো দেখি,  তখনই মনে খটকা লাগে যে আমাদের দেশের সাধারণ লোক আসল হাতে বোনা জামদানী চিনে না এবং কিনতে পারে খুব কম, তারা কম দামে মেশিনের জামদানী শাড়ী কিনে বেশী। তখনই নিজের শখের সাথে জামদানীকে সাথী করে নিলাম। যে আমার দেশের মানুষের হাতে আসল জামদানী পৌঁছে দেব এবং জানিয়ে দেব আসল জামদানী কোনটি। সেই ইচ্ছে বাস্তবায়ন করতে অনেকটা সময় লাগে, এরপর এবছর জুলাই এর শেষ এ আমার জামদানী নিয়ে অফিসিয়ালি কাজ শুরু হয়।

আপনার শাড়ি গুলোর বিশেষত্ব কি? ক্রেতা ভালো মানের জামদানি শাড়ি কিভাবে চিনতে পারে?

আমি ব্যবসায়ের চেয়ে আসল জামদানী শাড়ি ক্রেতার হাতে পৌঁছে দিতে বেশি পছন্দ করি। এজন্য আমার জামদানী শাড়ি গুলো খুব নরম সুতা, বেশি কাউন্টের গর্জিয়াস কাজ এবং যথেষ্ট গুনগত মান বজায় রাখার চেষ্টা করি। সাধারণত ৬০ – ১২০ কাউন্টের উপরের সুতার শাড়ি আমি বেশী রাখি, যেন ক্রেতা একটা জামদানী কিনে আত্মতৃপ্তি পায়। বেশি লাভের আশায় মেশিনের জামদানী নিয়ে কাজ করা আমার ব্যবসা বা আমার জামদানী নিয়ে কাজের বৈশিষ্ট্য নয়।

 একটা ভালো মানের জামদানী চিনার অনেক উপায় আছে, যদি ক্রেতার জন্য তা চিনা কঠিন, তবুও মূল্যবান জিনিস এমনিতেই চোখে পড়ে। সাধারণত ৪০ কাউন্ট থেকে ২০০ কাউন্টের সুতা পর্যন্ত জামদানী শাড়ি হয়। সুতার কাউন্ট যত বেশি হয়, তত সুক্ষ, নরম এবং ঘন কাজ হয় শাড়ি। এবং যে শাড়ির কাউন্ট বা সুতার ঘনত্ব বেশি, কাজও ঘন হয় তা বুনতে সময় ও লাগে বেশি, তাই দাম এক্ষেত্রে বাড়তে থাকে। তা ছাড়া এ শাড়ির উল্টো পিঠে সুতা কাটা পাওয়া যায় না, যা আসল জামদানী শাড়ির বৈশিষ্ট্য।

 

আপু জামদানী শাড়ি গুলো কোথায় থেকে সংগ্রহ করেন?

 বিসিক জামদানী পল্লী আমার বাসার কাছেই, যা শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় থেকে রূপসী, নরসিংদী পর্যন্ত বিদ্যমান। এখানে ঘরে ঘরে জামদানীর তাঁত এবং তাঁতি আছে। যাদের আপন ঘরই হাতে বোনা ঐতিহ্যবাহী আসল ঢাকাই জামদানী শাড়ির কারখানা। সেখানকার নিজস্ব তাঁতিই আমার জামদানীর কারিগর।

ব্যবসা করতে কোন বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়েছে কি? কিভাবে সেই বাধা অতিক্রম করেছেন?

ব্যবসা করব আর কোন বাধা সামনে পড়বে না তাতো হয় না। আমার দেড় বছরের জমজ বাচ্চা আছে, তাছাড়া সংসার এবং পরিবারের বিরূপ কথার উপরে নিজের ব্যবসাকে আগাচ্ছি। তাছাড়া ব্যবসায়ের জন্য যে মূলধন দরকার তাও আমার কম ছিল। তবে এই সমস্যা আস্তে আস্তে ব্যবসায়ের টাকা এবং আমার স্বামীর সহযোগিতায় কেটে উঠেছি।

আপনার অনলাইন ব্যবসার সফলতা সম্পর্কে আমাদের সাথে কিছু কথা শেয়ার করুন।

খুব সফল কথাটা এখনো বলছি না, তবে সফলতার পথে হাটছি ইনশাআল্লাহ। আমার স্বপ্ন আরোও সামনে এগিয়ে যাওয়ার, আমার কাজকে আরও প্রসারিত করার। প্রথমে তো যাদেরকে আমি পাশে পাবনা ভেবেছিলাম তারাই আমার ক্রেতা হয়েছে আগে। এছাড়া আনন্দের বিষয় ছিল দেশের বাহিরে সৌদি আরব, কানাডা এবং আমেরিকায় আমার রিপিট ক্রেতা হয়েছে। আমি শাড়ি ছাড়াও জামদানীর পাঞ্জাবি, থ্রী পিস নিয়েও কাজ করি। এগুলোও সমান ভাবে সবার কাছে সমাদৃত হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ্‌! 

যারা জামদানী নিয়ে কাজ করতে চায় তাদের জন্যে কিছু বলুন।

জামদানীকে নিয়ে অনেক পরিকল্পনা আছে আমার, যার উদ্দেশ্যে আমার ব্যবসা পেজ – শখের আচ্ছাদন কে সাজাচ্ছি। আমার উদ্দেশ্য ছিল দেশের ঐতিহ্যকে আধুনিক ভাবে সবার কাছে নিয়ে যাব। এটা আমাদের দেশের গর্ব, ঐতিহ্য। আমরা চাইলেই পারি আমাদের দেশের ঐতিহ্য, দেশের তাঁতিদের বাচিয়ে রাখতে। এজন্য যারা জামদানী নিয়ে কাজ করতে চান তাদের বলব, আপনারা তাঁতির হাতে বোনা আসল ঢাকাই জামদানী শাড়ি নিয়ে কাজ করবেন। নিজের লাভের আশায় মেশিনের জামদানী বা ইন্ডিয়ান জামদানী বিক্রয় করে ক্রেতা ঠকাবেন না। মনে রাখবেন ভালো এবং দামী জিনিস মানুষ দাম দিয়েই কিনবে, নিজের সততা বজায় রাখবেন, দেশকে এবং নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আর শাড়ি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কতো কাউন্টে বোনা শাড়ি সেদিকে অবশ্যই নজর রাখবেন। কারন এর উপরেই শাড়ির মোলায়েম ভাব, সৌন্দর্য্য নির্ভর করে। ধন্যবাদ সবাইকে।

আপু আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার সরাসরি তাঁত থেকে সংগৃহীত জামদানীর প্রসার দেশ জুড়ে ছড়িয়ে যাক, আরও বেশী বেশী প্রবাসীরা ক্রয় করুক, এই শুভ কামনা করছি। আর প্রিয় পাঠক আপনারা যারা নরসিংদীর জামদানী পল্লিতে সরাসরি যেতে পারছেন না, তারা ঘরে বসেই জামদানী পল্লীর শাড়ি পেতে যোগাযোগ করুন শখের আচ্ছাদন পেইজে আর ক্রয় করুন আপনার ভালোবাসার অরিজিনাল তাঁতের জামদানী শাড়িটি।


Leave a Reply

Your email address will not be published.