সংসার ও পড়ালেখার পাশাপাশি অনলাইন উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা নারীদের সংখ্যা নেহাত কম নয় কিন্তু। শত প্রতিকূলতা কাটিয়ে সফল হয়ে উঠছেন অনেকেই।অনেকেই বুঝে উঠতে পারছেন না কিভাবে সমস্যা গুলোর মোকাবেলা করবেন। আবার অনেকে এটাও জানেন না কোন সমস্যা টা গুরুতর আর কোনটা ছোট সমস্যা। যারা অনলাইন ব্যবসায় নতুন তাদের জন্যই আজকের এই গাইড লাইন, আমাদের পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সরমিন আক্তার সর্মি।
সরমিন আক্তার সর্মির পরিচয়
“আমার ব্যবসা মূল উদ্দেশ্য নিজের পায় দাড়ানো আর পাশাপাশি অটিস্টিক শিশুদের জন্য কিছু করার। আমি আসলে ব্যবসার মূল পুঁজি পাই আমার মায়ের বিক্রয় করা সম্পত্তির কিছু টাকা থেকে এবং তখনই আমি চিন্তা করি অল্প টাকা তে কিভাবে বেশি করব এবং অটিস্টিক শিশুদের জন্য কোন স্কুল খুলবো। এ লক্ষ্যে আমি আমার ব্যবসার টাকাটাই প্রসার করার চেষ্টা করি আমার ইচ্ছা এই টাকা দিয়ে মানুষের উপকার করা। আর বাকিটা আল্লার ইচ্ছা।” এভাবেই সরমিন আক্তার সর্মি ব্যক্ত করেন তাঁর অনলাইন উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য।
বাবার বাসা এবং শশুর বাসা দুইটাই রংপুরে।পড়াশোনা শেষ করেছেন পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে। পরিবারের সম্মতি নিয়ে ভালোবেসে বিয়ে করেন ২০১৩সালে।নিজের পায়ে দাঁড়ানো এবং চাকুরী করার ইচ্ছে ছিল ছোট থেকে কিন্তু হয়ে উঠেনি। ২০০৮ সালে মা মারা যায়। প্রসবকালীন জটিলতায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের মা মারা যান এবং রেখে যায় একটি সন্তান। মোট চার ভাই-বোনের মাঝে বড় হওয়ায় পুরো সংসারের দ্বায়িত্ব তিনি পালন করতে শুরু করেন। ছোট বাচ্চা ছোট ভাই বোন সব সামলিয়ে পড়াশোনা শেষ বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। বিয়ের পরে চাকুরীর চেষ্টা করবেন এমনটাই ছিলো পরিকল্পনা কিন্তু বিয়ের তিন মাসের মাথায় তিনি গর্ভবতী হন।কিন্তু দ্বিতিয় সন্তানের আগমন বার্তা আসতেই বুঝতে পারেন দুটি সন্তান সামলিয়ে চাকুরী করা সম্ভব নয়।বাচ্চারা একটু বড় হলে। ২০১৭ সালে অনলাইন শপিং এ তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতার কারনে মনস্থির করেন অনলাইনে ব্যবসা করবেন এবং মানুষ্কে মান সম্ম্যত পন্য দিবেন। কোন কিছু চিন্তা ভাবনা না করেই অনলাইন ব্যবসায় ঝাপিয়ে পড়লেন কিন্তু এভাবে তো আর ব্যবসা হয় না। তারপরে খুঁজতে শুরু করলাম যে বাংলাদেশ কোন জিনিসটার চাহিদা বেশি বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে কারণ অনলাইনে মেয়েরাই বেশি শপিং করে কসমেটিক এবং জামা কাপড়। এভাবেই তিনি বাছাই করলেন সালওয়ার কামিজ এবং শাড়ির ব্যবসাকে এবং তাঁর অনলাইন প্রতিষ্ঠানের নাম দিলেন আরাবি ফ্যাশান।আজ তিনি পারিবারিক এবং ব্যবসায়ীক সকল প্রতিকূলতা কাটিয়ে একজন সফল ব্যবসায়ী। তাঁর অভজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই আমরা কয়েকটি পর্বে শিখে নিবো কিভাবে প্রতিকুলতা কাটিয়ে সফলতা অর্জন করতে হয়।
যে সব নারীরা অনলাইন এ উদ্যোক্তা হতে চায়, অনেকেই বুঝতে পারে না কি নিয়ে কাজ করবে, এ ক্ষেত্রে পণ্য নির্বাচনে কোন কোন বিষয়ে নজর দেওয়া উচিৎ?
স.আ.স যারা নতুন ব্যবসা করতে চায় তাদের জন্য যদি তাদের নিজস্ব কোনো প্রতিভা থাকে যেমন আর্ট করা, ব্লক বাটিকের কাজ, রান্না করা, হাতের কাজ করা, গুছিয়ে কথা বলে মানুষকে কনভিন্স করা এরকম আরোও বিশেষ কোন দক্ষতা থাকে তারা তাদের সেইটুকুই দিয়ে স্বল্প পরিসরে ব্যবসা শুরু করতে পারে আস্তে আস্তে প্রসার হবে বলে আমি মনে করি। কারন আমি একজন বিবাহিত স্বল্প পরিসর থেকেই নিজের ব্যবসা কে সামনে এগিয়ে নিয়ে এসেছি। একবারে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হওয়া যায় না। যেকোন সফলতার সূচনা ছোট উদ্যোগ থেকেই হয়। এর জন্য অনেক বড় পূঁজির প্রয়োজন হয় না।শুধু মনে রাখতে হবে, যে কাজে আপনি আনন্দ পাচ্ছেন সে কাজ দিয়েই শুরু করুন, কাজকে ভালোবেসে ধৈর্যের সাথে সম্পন্ন করলে যেকোন কাজেই সফলতা আসে। আপনি যে কাজই করুন না কেন তাঁর মধ্যে যেন রুচিশীলতা এবং ইউনিক বৈশিষ্ট্য থাকে। ধরুন আপনি সালওয়ার কামিজ সেল করবেন, সালওয়ার কামিজের উদ্যোক্তা বাজারে হাজার হাজার আছে, তারপরেও ক্রেতা নিজে আপনার কাছে ছুটে আসবে যদি আপনি সবার থেকে আলাদা কিছু তাদের দিতে পারেন।অনেকে হ্যান্ড পেইন্ট নিয়ে কাজ করেন।ইউটিউবে বা পিন্টারেস্ট দেখে নকশা নিয়ে পেইন্ট করেন অনেকেই। এক্ষেত্রে নকশা গুলো সব সময়ই একই রকম হয় আর এতে ভিন্নতাও থাকে না। কাজেই এমন কিছু এখানে যোগ করুন যা সবার নজর কাড়বে। মোট কথা, আপনার ভালো লাগে এমন পন্য বাছাই করুন তারপর এতে নতুনত্ব যোগ করুন আর পন্যের গুনগত মান ঠিক রেখে হাতের নাগালে পন্যের মুল্য নির্ধারণ করুন। ক্রেতার চাহিদা পূরণ হলে ক্রেতাও আপনার চাহিদা পূরণ করবে। অলওয়েজ থিঙ্ক ডিফারেন্ট বি ডিফারেন্ট।
অনেকেই বুঝতে পারে না কিভাবে সোশ্যাল মিডিয়াতে মার্কেটিং শুরু করবে, এ অবস্থায় পণ্য মার্কেটিং করতে কি কি পদক্ষেপ এই সমস্যার সমাধান হতে পারে?
স.আ.স সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় প্রত্যেকটা উদ্যোক্তাকে। একজন বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী ছাড়া মানুষ কোন কিছুই কিনতে চায় না এইজন্য নিজেকে আগে মানুষের সামনে পরিচিত করে তুলতে হবে। এর জন্য প্রথমে নিজের পন্যের জন্য একটা পেইজ খুলতে হবে। বিভিন্ন পপুলার গ্রূপে নিজের পন্যের বিবরন দিয়ে এবং নিজের পরিচয় দিয়ে পোস্ট দিতে হবে।নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে।এসব কিছুই করতে হবে নিজের অরিজিনাল আইডি দিয়ে। ফেইক আইডি তে মানুষ কোন ভরসা পায় না আর এগুলো দেখতেও ফেকই লাগে।আপনি কোন কাজ শুরু করেছেন, এতে লজ্জার কিছু নেই, সবার আগে নিজের বন্ধু বান্ধব আর আত্বীয়দের জানান। পন্যের গুনগত মান ঠিক রেখে বাজারজাত করুন, দেখবেন রিপিট কাস্টোমারের অভাব হবে না। যারাই পন্য নিবে তাদের বিনয়ের সাথে আপনার পন্যের অনেস্ট রিভিউ দিতে বলুন আপনার পেইজে বা বিভিন্ন গ্রূপে। অনলাইনে প্রচুর সময় দিতে হবে।সরাসরি সেল পোষ্ট দিলে অনেকেই বিরক্ত বোধ করতে পারেন।আবার খুব বেশি গুরু গম্ভির কোথাও সকলের পছন্দ নয়। হালকা রসিকতা দিয়ে মাঝে পোষ্ট করতে পারেন, সাথে নিজের কাজের বিবরন আর নিজের পরিচয়টাও দিয়ে দিলেন। একই পোষ্ট বারবার করে কোন লাভ নেই এতে মানুষ সেটাকে বারবার স্কিপ করেই চলে যাবে।লাইভে আসতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। লাইভে এসেই সেল করতে শুরু না করে কুশল বিনিময় করা, খোশ গল্পের মাধ্যমে কিছু সময় পার করতে পারেন এতে দর্শক বাড়ে।লাইভে নিজেকে পরিপাটি করে আসতে পারেন। বিতর্কিত পোশাক এবং সাজ সজ্জা সব সময়ই বিতর্কের সৃষ্টি করে, এগুলো এড়িয়ে চলবেন। মনে করুন আপনি কোন অফিসে প্রেজেন্টেশন দিতে এসেছেন সেভাবে মার্জিত ভাবে লাইভে আসবেন। সব সময় সেল পোষ্ট না দিয়ে মানুষের উপকার হয় এরকম তথ্য, রুচিশীল কৌতুক বা ছবিও শেয়ার করতে পারেন।অনলাইন মার্কেটিং এর জন্য কিছু ডিজিটাল মার্কেটিং সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকলে কাজ করতে সুবিধা হয়।
কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এখানে শেয়ার করছি-
-অনলাইনে সবচেয়ে বেশি কেনাকাটা করে ২০-২৫ বছরের ছেলেরা এবং ৩০-৩৫ বছরের মেয়ে ক্রেতারা।
-০ থেকে ১০০০০/- তাকা উপার্জন করেন এরকম ক্রেতার সংখ্যা অনলাইনে সবচেয়ে বেশি।
-ক্রেতারা ক্যাশ অন ডেলিভারি সিস্টেমে ক্রয় করতে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন।
-পুরুষ এবং মহিলা উভয় ক্রেতার ক্ষেত্রেই তারা পোশাক এবং এক্সেসরিজ কিনে থাকেন অন্যান্য পন্যের তুলনায় অনেক বেশি।
আরো জানতে গ্রাফ দেখুন।
সংসার সামলে বিজনেস এর পিছনে সময় দিতে না পারার কারণে অনেকে শুরুতেই উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন বিসর্জন দিচ্ছেন, কিভাবে দুই দিকেই সময় দিয়ে পরিবার ও ক্যারিয়ার দুটোই ঠিক রাখা যায়?
একদম সংসারী উদ্যোক্তার সবচেয়ে বড় সমস্যা অনলাইনে সময় দেওয়া কারণ সংসার বাচ্চা সামলিয়ে ফোনে সময় দেওয়া আসলেই অনেক কষ্টের। এজন্য অনেকেই বিয়ের আগে ব্যবসা করলেও বিয়ের পর তা ছেড়ে দেয়। অনেক বিবাহিত নারীরা ব্যবসা শুরু করলেও পারিবারিক সমস্যার জন্য ব্যবসা ছেড়ে দেয়। এভাবে নিরাশ হলে চলবে না অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে তাহলেই মিলবে নির্দিষ্ট গন্তব্য। এক্ষেত্রে সংসারের কাজের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের রুটিন করতে হবে।কথায় বলে যত সকালে ঘুম থেকে উঠবেন ততবেশি আয়ু বাড়ে, তাই সময় যেহেতু আপনার ইচ্ছায় চলবে না আপনাকেই সময়কে কাজে লাগাতে হবে বুদ্ধি করে। বাসার রান্না, অন্যান্য কাজগুলো ভোর থেকে শুরু করে সকাল সকাল সব শেষ করে গুছিয়ে রাখলে দিনে ব্যবসার জন্য অনেকটা সময় হাতে পাওয়া যাবে।আপনি যদি সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে ব্যবসা করবো এই চিন্তা করেন তাহলে আপনি নির্ঘাত পিছিয়ে পড়বেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে মার্কেটিং এর ক্ষেত্রে মেয়েদের শুনতে হবে কাপড় বিক্রি করে, শাড়ি ওয়ালি, আজ অমুক শোক চলছে তাও সেলাররা সেল পোষ্ট কেন দিচ্ছে,টাকার অভাবে ব্যবসা করছে আরো কত রকম কটুক্তি তার শেষ নেই। আবার অনেকের ঘরের মানুষের কথাতেই টেকা দায়। অনেকের স্বামী, শ্বশুর বাড়ির লোকেরা মন্দ কথা বলে, অনেক সময় বাবার বাড়ির লোকেরাও ব্যপারটা ভালো ভাবে নেয় না। অনেক বান্ধবি বা আত্মীয়রা অভাবে আছো কি না এই সেই জিজ্ঞেস করে টিপ্পনি কাটে। এসবের পরেও কিন্তু মনোবল হারালে চলবে না মনে রাখতে হবে পিছন থেকে টেনে নিচে ফেলার জন্যই এই ধরনের মন্তব্য করার মানুষের অভাব নেই আবার আপনার সুফলতাতে এরাই আবার বাহবা দিবে। আবার এমনও হতে পারে সংসারের বিভিন্ন ঝামেলার জন্য মাসখানেক ব্যবসা বন্ধ থাকতে পারে তার পরেও লেগে থাকতে হবে সময় দিতে হবে অল্প হলেও আস্তে আস্তে আগাবে ইনশাল্লাহ।
অনলাইন উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বিড়ম্বনা অনেকেই পণ্যের মুল্য বিবরণ জিজ্ঞেস করে অনেক সময় নষ্ট করে কিন্তু কিছু ক্রয় করেনা এক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত?
অনেকেই দেখি স্ক্রিনশট দিয়ে বলে অমুক কাস্টোমার এতো গুলো প্রশ্ন করলো কিন্তু পন্য নিলোনা! বা এতোদিন ধরে পন্য নিবে নিবে বলে সময় নিলেও পরে বলছে সর্যি এখন নেওয়া সম্ভব না। আসলে অনলাইনের মানুষ যতটুকু না কেনে তার চেয়ে বেশি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে এতে বিরক্ত হলে চলবে না ধৈর্য সহকারে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে মনে রাখতে হবে ভালো ব্যবহারই আপনাকে একজন ভালো ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা করে তুলবে।অনলাইন ব্যবসায় ধৈর্য একমাত্র চাবিকাঠি কারণ সংসার সামলিয়ে ব্যবসা করা এবং কাস্টমারের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া দুটো নির্ভর করবে ধৈর্যের উপর। আমরাও যখন বাজারে যাই কখনই এক দোকানে জিনিস দেখে পন্য কিনি না, অনেকগুলো পন্য এলোমেলো করে নেড়েচেড়ে দেখে তারপরও হয়তো পাশের দোকানে যাই আরোও ভালো কিছুর আশায়। কাজেই অনলাইনেও এর ব্যতিক্রম হবে না।আপনি অনলাইন উদ্যোক্তা হোন বা অফলাইন উদ্যোক্তা, আপনার কাজের সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করবে, আপনার হাসিমুখে ব্যবহারের উপরে। আজ দু পয়সা যার কাছে লস করবেন আপনার ব্যভারে মুগ্ধ হয়ে ভবিষ্যতে তিনিই হতে পারেন আপনার পার্মানেন্ট কাস্টোমার ।
পরবর্তী পর্বে নজর রাখুন আমরা আরোও কিছু সমস্যার সমাধান দিবো ইনশাআল্লাহ।
2 Replies to “অনলাইন ব্যবসার সমস্যা ও সমাধান পরামর্শেঃ সরমিন আক্তার সর্মি (পর্ব ১)”